প্রতিক্রিয়া নোট: রাজা ত্রিদিব ও রাজাকার ত্রিদিব : ত্রিবিধ কথা (কুলদা রায়)
[ এটি কুলদা রায়ের একটি ফেসবুক নোটের জবাবে লেখা। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতার কারণে ব্লগে শেয়ার করা হলো ]
প্রিয় কুলদা রায়,
শুভেচ্ছা নেবেন। রাজা ত্রিদিব রায়কে নিয়ে লেখা এবং আমাকে ট্যাগ করা আপনার নোটটা সময়মতো পড়া হয়নি,তাই উত্তর দিতে একটু দেরি হয়ে গেলো।বিপরীত মত হলেই ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার চর্চায় আমি নেই। লেখা পড়ে একটু বিভ্রান্ত হয়েছি এই যা। কখনও কখনও এমন হয় একটা নির্দিষ্ট গন্ডীতে লিখলে সেই গন্ডীবদ্ধ লোকজনের বক্তব্য ও ভাবনার প্রভাবে প্রভাবিত হয় লেখক। এটা আমার কাছে সেরকম একটা লেখা মনে হয়েছে। মাহবুবুর রহমান জালালের সঙ্গে জুটি বেধে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখে যে কুলদা রায়, ইনি তিনি নন। যাহোক, অনুচ্ছেদক্রমে আপনার নোটের যে জায়গাগুলোতে আমার ভিন্নমত, তা প্রকাশ করছি।সেটা আপনার নোটে দিতে গিয়ে জায়গায় কুলালো না,তাই আলাদা নোটই দিলাম।
১.
আপনার ভ্রান্তি (আমার চোখে) শুরু হয়েছে নোটের একদম শুরু থেকেই। নির্দিষ্ট করে বললে চতুর্থ লাইন থেকে।
‘ত্রিদিব রায়ের দুটি পরিচয়।
এক. তিনি ব্যক্তি ত্রিদিব। দুই. তিনি চাকমাদের রাজা ত্রিদিব। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে ত্রিদিব মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। রাজাকারি করেছেন। থেকে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে।’
ব্যক্তি ত্রিদিব রায় কিন্তু একজন চমৎকার মানুষ। অসাধারণ রসবোধসম্পন্ন, প্রচুর পড়াশোনা, সঙ্গীতজ্ঞ, গাছপ্রেমী, শিল্প রসিক,লেখক, কবি- বলে শেষ করা যাবে না এতই গুণী। তার পদবী চাকমাদের রাজা এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো তার এই স্বত্বাটাই। রাজা নিজেই শুধু যদি সমর্থন দিতেন বলতেন আমি পাকিস্তানের পক্ষে (যেমন অনেকেই ছিলেন) তাহলে তো ল্যাঠা চুকে যেত। সিদ্ধান্তটা তিনি দিয়েছেন চাকমা রাজা হিসেবে, চাকমাদের হয়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের অনুগামী এবং সহযোগী হিসেবে চাকমাদের পেয়েছে, তাদের রাজার নির্দেশে। কিভাবে সেটা আমি বিস্তারিতই লিখেছি আমার একটা পোস্টে। সময় পেলে একবার চোখ বোলাবেন প্লিজ।
২.
চাকমাদের রাজা একটা সম্মানিত পদ বটে, সেটা রাষ্ট্রের কাছে। আদিবাসি/উপজাতি (যেটাই বলেন)গোষ্ঠী প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রের সঙ্গে দেন-দরবার এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সেই দেন-দরবারে ব্যক্তিগত লাভের বিনিময়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া। ষাটের দশকের শুরুতে কাপ্তাই বাঁধে যে লাখো চাকমা তাদের সর্বস্ব হারিয়ে উদ্বাস্তু হলো, অরুনাচল মিজোরামে মায়ানমারে রিফিউজির তকমা নিয়ে ঘুরে বেড়ালো (এবং বেড়ায়) তাদের জন্য কি করেছেন ত্রিদিব রায়? তিনি কি বিদ্রোহ করেছেন? না, বরং আইয়ুব খানের এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা দিয়েছেন গোষ্ঠীর কাছে, মেনে নিতে বলেছেন। সে সময়টাতেই তিনি রাজা হয়েছেন আর সে অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়েছেন আইয়ুব। সেই অনুষ্ঠানেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ৫ কোটি রুপি ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়ার ঘোষণা দেন ক্ষতিগ্রস্থ চাকমাদের। সরকারী নির্দেশে চাষের জমি একরপ্রতি আড়াইশো রুপি এবং বাড়িঘরের জন্য গড়ে চারশো রুপি নির্ধারিত হলো। কিন্তু পাহাড়ের মানুষেরা কখনও ভিটেজমির দলিল করা প্রয়োজন মনে করেনি। তাই ফুটো পয়সাও জুটলো না কারো। সাড়ে তিন কোটি রুপি অব্যবহৃত রয়ে গেলো, বাকি দেড় কোটির ভাগাভাগি যে কজনের কপালে জুটলো তাদের একজন ত্রিদিব রায়, কর্নফুলির যে জল তার রাজবাড়ির একাংশ জলমগ্ন করেছিলো তা সূরম্য লেক হয়ে গেছে তারপর।
সেই প্রেক্ষাপটে ত্রিদিবও চাকমাদের কাছে একরকম দালালই বটে। তার ছেলেও যেমন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের পাশে বসে শান্তি সমাবেশ করেন, বুটের লাথি মেনে নিতে বলেন। তাই ত্রিদিবের লাশ সমাহিত করা চাকমাদের দাবি, এই দাবি পূরণ না হলে তারা বিদ্রোহ করবে, অপমানিত বোধ করবে- এটা একটা ফালতু কথা। ত্রিদিব ‘পাহাড়ের ঈশ্বর’ মানবেন্দ্র লারমা নন, ত্রিদিব ‘পাহাড়ের দেবতা’ সন্তু লারমা নন। যাদের প্রতি বিন্দুমাত্র কটুক্তি প্রতিটি জুম্মবাসী ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নেন। বরং প্রীতি চাকমাকে কেনায় ও ব্যবহারে সমঝোতার অভিযোগই রয়েছে রাজপরিবারের বিরুদ্ধে। যেই অঞ্চলে মানবেন্দ্র লারমা শুয়ে, সেখানে ত্রিদিবের সমাধি চাকমা সংহতির জন্য প্রীতিকর কোনো বার্তা নয়। বরং যে মানুষটা রাজক্ষমতায় চাকমাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অংশ বানিয়ে বাঙালীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলো, স্বাধীন দেশে বাঙালীদের, মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রু বানিয়ে নিজে পালিয়ে গেলো, তাদের পাশে রইলো না,দায় কাধে নিয়ে শাস্তি ভোগ করলো না, তাকে চাকমারা নিজেদের অতি আপন শ্রদ্ধেয় একজন মানে, এটা কেনো জানি আমার কাছে কষ্টকল্পনা মনে হয়।
৩.
দ্বিতীয় অনুচ্ছদের শেষ লাইনে আপনি প্রশ্ন করেছেন ত্রিদিবের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র যুদ্ধাপরাধের মামলা করেছে কিনা। এবং নিজেই উত্তর দিয়েছেন করেনি বলে। আশ্চর্য হলাম হাতের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বকোষ মাহবুবুর রহমান জালাল ভাই, তাকে একবারও প্রশ্নটা করা প্রয়োজন মনে করলেন না! ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) আইনে (রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নং-৮)অভিযুক্ত হয়ে নোটিশ পেয়েছিলেন রাজা ত্রিদিব রায়। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ বেলা তিনটায় রাঙামাটি কোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রাম সদরের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য তার প্রতি সমন জারি করা হয়েছিলো। সমন নং-১১০, রাজ-৪, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। একই সমন গোলাম আযমসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীও পেয়েছেন। মোশতাক ও জিয়া সরকার যখন দালাল অধ্যাদেশ বাতিল করে দেয়, তখন সেই আইনের কার্যকারিতা থাকে না বটে কিন্তু যেই ৭৩এর অধ্যাদেশের আওতায় গোলাম আযমদের বিচার চলছে। সেই সহযোগিতার দায়ে ত্রিদিব রায়ও পড়েন। অনুগত চাকমাদের ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সে যোগ দিতে নির্দেশ দেওয়া এবং এই সহযোগী বাহিনীর যাবতীয় যু্দ্ধাপরাধের দায়ে গোত্রপ্রধান হিসেবে তার ওপরই বর্তায়।
এবং এই নির্দেশনা তিনি স্রেফ রাজা হিসেবেই খাটাননি। তার আরেকটি সনদ ছিলো, ৭০এর নির্বাচনে নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন তিনি, সেই আসন বাতিল করেনি পাকিস্তান সরকার, তাই গোটা পাহাড়ে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার ও প্রয়োগের আইনী হাতিয়ার তার ছিলো। ত্রিদিব তা ব্যবহারও করেছেন। তৃতীয় অনুচ্ছদে আপনি যা বলেছেন তার উত্তর উপরেই দেওয়া হয়ে গেছে। ত্রিদিবকে সমাধিস্থ করার দাবি চাকমাদের দাবি নয়, এটা রাজপরিবারের অনুরোধ, রাজা দেবাশীষ রায়ের। ত্রিদিবকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য চাকমারা মিছিল করেছে বলে শোনা যায় নি।
৪.
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বন্দুকের নলের মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী যেসব সিদ্ধান্ত আমাদের গিলতে বাধ্য করেছে সরকার, স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন, তাদের বিরুদ্ধে আনা অধ্যাদেশ বাতিল, মামলা এবং কারাগার থেকে রেহাই- এসবের দোহাই দেওয়াটা ছেলেমানুষি। কারণ এগুলো নাগরিক দাবি ছিলো না, ছিলো মননে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সরকারী সিদ্ধান্ত। গণতান্ত্রিক আবহ ফিরে আসার পরই আবার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। নিজামী-মুজাহিদরা মন্ত্রী হতে পেরেছে বলে আমাদের সব মেনে নিতে হবে, প্রতিবাদ করা বাদ দিতে হবে, এত সুশীল তো এখনও হতে পারিনি দাদা আমরা।
ত্রিদিব রায়কে বঙ্গবন্ধুর সরকার ফিরে আসতে বলেছিলেন। তিনি তা অগ্রাহ্য করেছেন। জাতিসংঘে আমাদের সদস্যপদের বিরুদ্ধে চীনের ভেটো দেওয়ার যৌক্তিকতাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে। পাকিস্তানি হিসেবে নিজেকে জাহির করেছেন, উর্দুতে কবিতা লিখেছেন, আজীবন মন্ত্রীত্বের সম্মাননা ভোগ করেছেন।
তো সব আমাদের ভুলে যেতে হবে? ঠিক কোন যুক্তিতে বলেন তো? না তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা করতে চাইছে না কেউ। কেউ বলছে না তার মরণোত্তর শাস্তির কথা। দাবি একটাই ত্রিদিব রায়ের লাশ বাংলাদেশে সমাহিত করা যাবে না, উচিত হবে না। কারণ যিনি ঠাণ্ডা মাথায় পাকিস্তানের পক্ষে আনুগত্য জানিয়েছেন, সেই আনুগত্য চল্লিশ বছরের উপর বজায় রেখেছে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেননি, এই দেশকে নিজের মনে করেননি, এর অস্তিত্বের বিরু্দ্ধে যিনি তৎপরতা চালিয়েছেন, পাকিস্তানী হিসেবে মরেছেন- তাকে বাংলাদেশে সমাহিত করে কি প্রমাণিত হবে? এ দেশ দালালদের পূন্যভূমি? আমরা মরে গেলেই ভুলে যাই? ঘটা করে একজন পাকিস্তানীর লাশ এদেশে আসবে, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচার পাবে, এটাকে কিভাবে দেখবো আমরা, রিকনসিলিয়েশনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে? ধিক্কার দেই এমন ভাবনায়।
শেষ কথা:
ত্রিদিবের লাশ এ দেশে সমাহিত হলে সেটা হবে বাঙালীদের জন্য চরম এক অপমান। একইভাবে চাকমাদের জন্য এটা হবে অত্যন্ত বিব্রতকর। এবং দুই জাতিস্বত্বার বন্ধুত্বে একটা বড় কাঁটা হয়ে থাকবে যা পারস্পরিক বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটা জঘন্যতম উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হবে।আপনার মরণোত্তর বিচারের আইডিয়াটা বরং তাদের অহমে লাগতে পারে, তার চেয়ে যেখানে সারাজীবন থাকলেন সেখানেই থাকুন,যেখানে মরলেন সেখানেই সমাহিত হোন, পাকিস্তানকে কেবলা বানিয়ে যারা তাকে ধিক্কার দেওয়ার দেবেন, যারা উপাস্য মানবেন, তারা উপাসনা।
কুলদা রায়ের মূল লেখা যা তিনি নোট হিসেবে দিয়েছিলেন
এ বিষয়ে আরো দুটো লেখা:
১। ত্রিদিব বিষয়ে ত্রিবিধ প্রতুত্তর
২। প্রিয় স্বদেশ, কী করে বইবে তুমি ত্রিদিবের বোঝা?