এক পাকিস্তানী খুনীর বই-ব্যবসার নিকুচি…

এক পাকিস্তানী খুনীর বই-ব্যবসার নিকুচি…

[এটি ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসেবে দিয়েছিলাম, কিছু তথ্য যোগ করে ব্লগ উপযোগী করলাম]

গত দুদিন ধরে হঠাৎ প্রয়াত পাকিস্তানী জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার একটি মেমোয়ার নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ দেখতে পাচ্ছি। বেশ কয়েকজন জানতে চেয়েছেন আমি বইটার খোজ রেখেছি কিনা, সবিনয়ে জানিয়েছি যে রেখেছি। এই হৈ চৈয়ের কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে বইয়ের কিছু চুম্বক অংশ বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে যাতে এথনিক ক্লিনসিং (হিন্দুদের নির্বংশ করা) এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (বাঙালীর গর্ভে পাকিস্তানী পয়দা করা) প্রতিষ্ঠিত সূত্রগুলোই সমর্থিত হয়েছে। এবং চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে এসবের জন্য নিয়াজীকে অভিযুক্ত করেছেন রাজা।

চলুন খাদিম হোসেন রাজার পরিচয়টা একটু জানি। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যেসব পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে শীর্ষেই আছেন জেনারেল খাদিম। নির্দিষ্ট করে বললে ১৬ নম্বরে । তো একাত্তরে কি এমন করেছিলেন খাদিম সাহেব যার জন্য তাকে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাভুক্ত করেছিলাম আমরা? ২৫ মার্চ রাতে যে গণহত্যাটির মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু, নীল নকশাটির মূল প্রণেতা জেনারেল সাহেব। তার খসড়াটির নাম ছিলো অপারেশন ব্লিৎজ। ২২ ফেব্রুয়ারি জেনারেলদের মিটিংয়ে তা আরেকটি ঘষামাজা করা হয় রাও ফরমান আলীর তরফে এবং নাম দেওয়া হয় অপারেশন সার্চলাইট। রাও ফরমান আলীর উপর দায়িত্ব ছিলো ঢাকা শহরে বিদ্রোহ দমনের নামে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং হিন্দুদের খতম করা। আর খাদিম হোসেন রাজার উপর বাকি প্রদেশে- অর্থাৎ গোটা বাংলাদেশে। ঢাকার বাইরে প্রতিটি সেনানিবাস, পুলিশ ব্যারাক, ইপিআর ক্যাম্প এবং সাধারণ মানুষের উপর গণহত্যার দায়ে দায়ী খাদিম হোসেন রাজা।

এ বিষয়ে আমরা আমলে নিতে পারি সে সময়কার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) সিদ্দিক সালিককে। খাদিম হোসেন রাজা সম্পর্কে সিদ্দিক সালিকের ভাষ্য হচ্ছে অপারেশন সার্চলাইটের দ্বিতীয় অংশটা তিনি লিখেছেন : In the same sitting, General Farman wrote down the new plan on a light blue office pad, using an ordinary school pencil. 1 saw the original plan in General Farman’s immaculate hand. General Khadim wrote its second part, which dealt with distribution of resources and the allocation of tasks to brigades and units.
The plan, christened ‘Operation SEARCHLIGHT’, consisted of sixteen paragraphs spread over five pages (See Appendix’ III). It presumed that all Bengali troops, including regular East Bengal battalions, would revolt in reaction to its execution. They should therefore, be disarmed. Secondly, the ‘non?cooperation’ movement launched by Mujib should be deprived of its leadership by arresting all the prominent Awami League leaders while they were in conference with the President. The plan also listed, as an annexure, sixteen prominent persons whose houses were to be visited for their arrest.
The hand-written plan was read out to General Hamid and Lieutenant?General Tikka Khan at Flagstaff House on the afternoon of 20 March. Both of them approved the main contents of the plan but General Hamid struck out the clause pertaining to disarming the Bengali troops as `it would destroy one of the finest armies in the world’. He, however, approved the disarming of paramilitary forces like the East Pakistan Rifles and the Police. He asked only one question, ‘After distribution of these troops for various tasks, are you left with any reserves?’ ‘No, Sir,’ was the prompt reply from the G.O.C. (এখানে জিওসি হচ্ছেন খাদিম হোসেন রাজা)
(Witness To Surrender: by Siddiq Salik Page # 63 ):

যোগ করেছেন: Major General Khadim then sent a column of 20 Baluch under Lieutenant Colonel Fatimi. Once again, Fatimi managed to involve himself in some sort of engagement with the rebels on the way and, never reached the transmitters. Finally, two F-86s (Sabres) from Dacca had to knock them out. I visited the sight a few days later and found the building well fortified with pillboxes and foxholes – all interconnected with a fine network of trenches. The building was intact. The other principal target was the East Pakistan Rifles Headquarters where 1,000 armed rebels were well entrenched. Located on high ground, they had artfully laid their defences along the embankment with holes and slits to facilitate small arms fire. Our troops knew the odds and prepared a massive attack to neutralize them. The attacking troops, approximately in battalion strength, had the support of a naval destroyer, two gunboats, two tanks and a heavy mortar battery. The battle raged for three hours before the defiant rebels could be subdued. This happened on 31 March- the sixth day of operation SEARCHLIGHT.
The next target was the Reserve Police Lines where 20,000 rifles were reportedly stocked, to be used by an assortment of rebels. A battalion-strength attack was launched there, too, but the defenders proved less dogged than the East Pakistan Rifles personnel and soon withdrew towards the Kaptai Road.
The key role in neutralizing these points of resistance was played by Brigadier Ansari. His gallant services were later recognized by the award of the Hilali-Juratl and promotion to the rank of Major General (although earlier he had been superseded).
The main operations in Chittagong were over by the end of March, but the mopping up action continued until 6 April. The other two towns where the rebels had an upper hand were Kushtia and Pabna. Let? us see how our troop fared there.
Kushtia, about 90 kilometres from Jessore, is an important road and rail junction. Our troops were not permanently located there but, on the D-day, 27 Baluch (Jessore) had sent one of its companies just to establish our presence there’. For want of proper briefing the company carried only small arms, a few recoilless rifles and a limited quantity of ammunition. They thought that they were going on normal internal security duty, which usually did not involve heavy fighting.
The company commander distributed his manpower in small groups and assigned them the task of guarding the telephone exchange and V.H.F. station. He also sent small parties to arrest the local Awami League leaders?but they had all left. He established his presence, after killing five rebels on the first day (26 March). Thereafter it was only enforcement of curfew and collection of arms from the civilians. Two days passed peacefully.
(Witness To Surrender:Page # 82-83)

তাহলে তিনি কি সাফাই দিবেন? তিনি কি এই বইয়ে দোষ স্বীকার করেছেন তার। কি নির্মম নিষ্ঠুরতায় বিদ্রোহ দমনের নামে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন গোটা দেশজুড়ে তার জন্য কি আত্মদহনে ভুগেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন বাংলাদেশের মানুষদের কাছে? স্নিপেটসগুলো সে ইঙ্গিত দেয় না। বরং তার অভিযোগের তর্জনি ঘুরে ফিরে নিয়াজির দিকে, যে কিনা ১৬ ডিসেম্বর পরাজয়ের আগেও তার বাঙালী গার্লফ্রেন্ডদের ভাগ চেয়েছিলো বলে ক্ষুন্ন খাদিম। নিয়াজি বাংলাদেশে এসে দায়িত্ব নিয়েছেন ১১ এপ্রিল। তার আগ পর্যন্ত টিক্কা খান ছিলেন গভর্নর। কিন্তু সামরিক নির্দেশনা ছিলো খাদিম হোসেন রাজার হাতে। বিদ্রোহ পরিপূর্ণভাবে দমন করা হয়েছে বলে ৭ এপ্রিলই মোটামুটি পাকিস্তানের সব পত্রিকায় খবর এসেছিলো তার বরাতে। এবং ১০ মের মধ্যে গোটা প্রদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রশান্তি নিয়ে তিনি মেজর জেনারেল রহিম খানকে কমান্ড হস্তান্তর করে ফিরে যান দেশে।

অনেকগুলো মিথ্যে কথা আছে খাদিমের মেমোয়ারে। যেমন : বইয়ের বিজ্ঞাপনে নিয়াজীর বাঙালী মেয়েদের ব্যাপক ধর্ষনের ফতোয়া শুনে নাকি মেজর মোশতাক নামে একজন বাঙালী অফিসার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন বলে লিখেছেন খাদিম। বাস্তবে এই মোশতাকের পদবী ক্যাপ্টেন। তিনি পাকিস্তানী আর্মি ইন্টেলিজেন্সে ছিলেন এবং ২৯ মার্চ দিনাজপুরে নিহত হন। তখন নিয়াজি পাকিস্তানে। এছাড়া আর কোনো বাঙালী মোশতাক ছিলো না তখন। সামছুল আরেফিন সংকলিত মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান বইয়ে পাকিস্তানীদের পক্ষে থাকা বাঙালী অফিসারদের পূর্ণ তালিকা আছে। সেখানে মোশতাকের এই বর্ণনাই আছে।

এবার দেখা যাক স্মৃতিকথায় নিয়াজী কি বলছেন : On 25 March General Tikka Khan had available to him for military action only 14 Infantry Division, under the command of Major General Khadim Hussain Raja. It consisted of four brigades, located in different cantonments and camps all over East Pakistan. In the division there were twelve infantry battalions (all West Pakistan), seven infantry battalions (all East Pakistan) and one commando battalion (mixed). These battalions had officers from both West and East Pakistan. In supporting arms he had one light tank regiment, five regiments of field artillery, one regiment of light anti-aircraft artillery, and two mortar batteries. Troops in these units were mixed West and East Pakistanis. There were sixteen wings of the East Pakistan Rifles, about sixteen thousand strong these were all East Pakistanis except a few officers and junior commissioned officers from West Pakistan. There were also naval and air force troops, some of which could be used in a ground role in Chittagong and Dhaka.
It should be borne in mind that the Bengali troops had not yet mutinied. General Tikka had enough strength available to complete his task. The requirements were proper planning, intelligent conduct of operations, and patience, because facing him was not a regular army but dissident armed civilians. More tact than tactics was the order of the day
On the night between 25/26 March 1971, General Tikka struck. Peaceful night was turned into a time of wailing, crying, and burning. General Tikka let loose everything at his disposal as if raiding an enemy, not dealing with his own misguided and misled people. The military action was a display of stark cruelty, more merciless than the massacres at Bukhara and Baghdad by Changez Khan and Halaku Khan, or at Jallianwala Bagh by the British General Dyer.
General Tikka, instead of carrying out the tasks given to him, i.e., to disarm armed Bengali units and persons and to take into custody the Bengali leaders, resorted to the killing of civilians and a scorched?earth policy. His orders to his troops were: `I want the land and not the people.’ These orders were carried out in letter and spirit by Major-General Farman and Brigadier (later Lt. Gen.) Jahanzeb Arbab in Dhaka. Major-General Rao Farman had written in his table diary, `Green land of East Pakistan will be painted red.’ It was painted red by Bengali blood. This diary was found by the Bengalis when they occupied Government House on 14 December 1971. Mujib showed the diary to Bhutto during his visit to Bangladesh. Bhutto inquired from me about this diary during my meeting with him.(The Betrayal of East Pakistan : -Lt. Gen. A. A. K. Niazi; Page # 44, 46 )

পাকিস্তানী জেনারেলদের এই কাদাছুড়াছুড়ি অবশ্য নতুন কিছু না। তাদের প্রত্যেকেই মরার আগে একটি করে স্মৃতি কথা লিখেছেন এবং পরস্পরকে দোষারোপ করেছেন। ব্যাপারটার অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন মুনতাসির মামুন তার ‘ দ্য ভ্যাঙ্কুইশড জেনারেলস অ্যান্ড দ্য লিবারেশন ওয়ার অব বাংলাদেশ বইয়ে (বাংলায়: পাকিস্তানী জেনারেলদের মন, বাঙালী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ)।

http://www.esnips.com/displayimage.php?pid=34151302

আবার স্মৃতিকথায় পাকিস্তানীদের মার্শাল রেসের বিপরীতে তার অবস্থানের কথা বলেছেন খাদিম। দাবিটা যে মিথ্যা যে মিথ্যা তার প্রমাণ পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ডিফেন্স এনালিস্ট মেজর (অবঃ) আগা হুমায়ুন আমিনের বয়ানে যে ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীতে বাঙালী রেজিমেন্টের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন খাদিম হোসেন রাজা। তার যুক্তি বাঙালীদের বিশ্বাস করা যায় না এদের উপর ভরসাও করা যায় না, তাই পাঠান এবং পাঞ্জাবীদের সঙ্গেই বরং তাদের মিশিয়ে দেওয়া উচিত। ভারতের বিরুদ্ধে ‘৬৫র যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়ার পরও বাঙালীদের বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকতে হয়। আগা আমিনের ভাষ্যে : Yahya cannot be blamed for the muck that had been accumulating for more than two decades. Yahya’s intention to raise more pure Bengali battalions was opposed by Major General Khadim Hussain Raja, the General Officer Commanding 14 Division in East Pakistan, since the General felt that instead of raising new purely Bengali battalions, Bengali troops should be mixed with existing infantry battalions comprising of Punjabi and Pathan troops.

Such was the strength of conviction of General Khadim about not raising more pure Bengali battalions that once he came to know about Yahya’s orders to raise more East Pakistani regiments, he flew to the General Headquarters in Rawalpindi to remonstrate against the sagacity of raising more pure Bengali units. Khadim’s advice that Bengali troops could not be relied upon in crisis situations should have been an eye opener for all in the GHQ. No one at least at that time took his advice seriously. It appears that the generals were convinced that the Bengali was too meek to ever challenge the martial Punjabi or Pathan Muslim. The Bengalis were despised as non martial by all West Pakistanis. However much later an interesting controversy developed in which the Punjabis and Hindustanis blamed each other for doing so! The Hindustanis blaming Aziz Ahmad etc and the Punjabis blaming many Hindustani ICS old foxes of the 1950s! There is no doubt that this exercise in Bengali degrading was neither totally or exclusively Punjabi led but a a true for all West Pakistanis business!

The foreign reader may note that Bengalis were despised as a non martial race from the British times. Sir Syed Ahmad Khan a Hindustani Muslim and an eminent Muslim leader of the North Indian Muslims in late 19th century made open fun of Bengalis in his various speeches, notably the one delivered at Lucknow in 1887. I.H Qureshi another prominent Hindustani Muslim and a post 1947 cabinet minister declared in a roundabout manner that the Bengalis were an inferior race. Ayub made various remarks implying that the Bengalis were an inferior race in his memoirs written in 1967.

তো এত হৈ চৈয়ের কারণটা আসলে আমার মাথায় ঢুকছে না। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের এই বাড়াবাড়ির পিছনে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকতেও পারে। কারণ তাদের প্রথমা নামে একটা প্রকাশনী আছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানী কোনো জেনারেলের বইই পাকিস্তানে কেউ পড়ে না, যা পড়ে এই বাংলাদেশেই। তো প্রয়াত জেনারেলের এই বইয়ের বাংলাদেশী পরিবেশক হিসেবে প্রথম আলো তাদের প্রথমা প্রকাশনী দিয়ে একটু ফায়দা লুটতেই পারে। কথা হচ্ছে আমি তাদের সে সুযোগ দিবো কিনা। উত্তর হচ্ছে দিবো না।

নিয়াজির উপর দোষ চাপালেই খাদিমের হাতের রক্তের দাগ মুছে না। পুরানো অভিযোগের নতুন স্বীকারোক্তিও তাতে আলাদা কোনো মাত্রা যোগ করে না। বরং প্রথম আলো গ্রুপের রিকনসিলিয়েশন থিওরীর বলে খাদিমের প্রতি সহানুভূতি জাগানোর যে কোনো পরিকল্পনায় আমি সরোষে থুতু দিই। স্যরি খাদিম তোমার বই কিনে তোমাকে কবরেও প্রশান্তির প্রলেপ আমি দিতে পারি না। আমি বর্জন করলাম তোমাকে, তোমার বইকে, পাকিস্তানী জেনারেলদের ব্লেম গেমের ধারায় তোমার অন্তর্ভুক্তিকে। বড়জোর কেউ যদি পয়সা খরচ করে কিনেই সেটা স্ক্যান করে গোটা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেবো তোমার এবং তোমার মরনোত্তর পৃষ্টপোষকদের লোভের বাড়া ভাতে ছাই দিতে। নিকুচি করি তোমাদের বানিজ্যনীতির।

জয় বাংলা।

লেখকঃ অমি রহমান পিয়াল