রাজা(কার) ত্রিদিব রায় : এ লাশ সইবে না বাংলার মাটি
[লেখাটি মূলধারার মিডিয়ার জন্য লেখা হয়েছিলো। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায় বিষয়ে বাংলাদেশের যাবতীয় মিডিয়া হঠাতই রেডিও সাইলেন্স বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মনে হচ্ছে, পুরাই ব্ল্যাক আউট। তাই আসল জায়গাতেই দিতে হচ্ছে। মূলত ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসেবে শুরু করেছিলাম এর কিছু অনুচ্ছেদ, কিছু তথ্যে ভ্রান্তি ছিলো, সেগুলাও ঠিক করে দিলাম সঠিক রেফারেন্স ঘেটে]
নৃতাত্বিকভাবে বাঙালী নয় কিন্তু নাগরিকত্বে বাংলাদেশি এমন আলোকিত মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয় বাংলাদেশে। উপজাতি কিংবা আদিবাসী বলে পরিচিত এদের অনেকেই শিক্ষায় এবং কর্মে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের কথাই ধরা যেতে পারে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রেক্ষাপট ধরলে নিঃসন্দেহে তাকে এবং অনেককেই বহুগুণে ছাড়িয়ে যাবেন তার বাবা। রাজা ত্রিদিব রায়। কিন্তু তার সেই আলোকিত রূপ বাংলাদেশের কোনো উপকারে আসেনি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রতিই আনুগত্য বজায় রেখেছেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত সে দেশের মন্ত্রীর মর্যাদায় অধিভুক্ত ছিলেন তিনি। এবং রাজা ত্রিদিব রায় একজন যুদ্ধাপরাধী। আমাদের স্বাধীনতার বিরোধীতায় এবং স্বাধীনের পরও স্বীকৃতির বিরুদ্ধে তৎপরতা চালিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে তার মরদেহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সমাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে আপত্তি নেই বাংলাদেশ সরকারের। আর কারও থাক বা না থাক, আমার আপত্তি আছে। বাংলাদেশের একজন নাগরিক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিতদের একজন হিসেবে আমি আমার সেই আপত্তি এবং আপত্তির কারণ তুলে ধরছি।
প্রথমেই আসি মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের ভূমিকা নিয়ে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলো। পক্ষে এবং বিপক্ষে। এখানে লক্ষণীয় তাদের বসবাসের জায়গাটা সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় সেখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী- দুইপক্ষই ছিলো ভীষণভাবে তৎপর। এই পর্যায়ে এসে আদিবাসীরা গোষ্ঠীগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোন পক্ষে যাবে। মগ, সাঁওতাল এবং গারোরা সরাসরি পাকিস্তানের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। চাকমারা পক্ষে। রাজা মংপ্রু সেনের নেতৃত্বে মগরা মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোতভাবে সহায়তা করেছে । এই যে সহায়তা কিংবা বিরোধিতা- এটা গোষ্ঠীগত সিদ্ধান্ত, গোষ্ঠী প্রধানের নির্দেশ। এখানে সমর্থন অর্থে বলা হয়েছে। এই সমর্থনের অর্থ ইনটেলিজেন্স, আশ্রয় এবং লোকবল দিয়ে সহায়তা। প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর হয়ে মগরাই শুধু নয়, গারোরা লড়েছেন, সাওতালরা লড়েছেন। ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ এবং ইপিআরের সদস্য যেসব আদিবাসী ছিলেন তারা লড়েছেন। এদের মধ্যে মারমা-মুরং-গারো-লুসাই সব গোষ্ঠীই ছিলেন। ছিলেন কিছু চাকমাও। আর তারা তাদের সম্প্রদায়গত সিদ্ধান্তের বদলে প্রায়োরিটি দিয়েছেন কর্তব্যবোধ এবং ক্যামোরেডরিকে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তার সিদ্ধান্ত ছিল চাকমাদের। তাদের এই সিদ্ধান্তটা এসেছে রাজা ত্রিদিব রায়ের তরফে। তিনি গোষ্ঠীপ্রধান। এপ্রিলের মাঝামাঝি, নির্দিষ্ট করে বললে ১৬ তারিখ রাঙ্গামাটিতে পাকিস্তান থার্ড কমান্ডো ব্যাটেলিয়ান অবস্থান নেয়। স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের এলিট কমান্ডোদের প্রধান মেজর জহির আলম খান (২৬ মার্চ রাতে যিনি শেখ মুজিবকে গ্রেফতারে নেতৃত্ব দেন) ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে দেখা করে সবধরণের সহায়তার প্রতিশ্রুতি পান। সঙ্গে যোগ দেয় লালডেঙ্গার নেতৃত্বাধীন মিজোদের একটি ব্রিগেড। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মুক্তিবাহিনী এবং বিএসএফের সম্ভাব্য তৎপরতা এবং তা ঠেকানোর জন্য সহায়তার কথা ছিলো সে প্রতিশ্রুতিতে। শুধু ত্রিদিব রায়ের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী দলই নয়, রাঙামাটিতে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস (ইপিসিএএফ) প্রাথমিকভাবে যোগ দেয় প্রায় শ’তিনেক চাকমা। যুদ্ধশেষে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের সংখ্যাটা এক মাসে ছিলো দেড় হাজারের ওপর। যদিও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় তাদের সবাইকেই পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া জহির আলম খান তার আত্মজীবনী ‘দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ’ বইয়ে চাকমা এবং মিজোদের সহায়তায় পার্বত্য অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে নানা তৎপরতা ও সাফল্যের বর্ণনা বিস্তারিত লিখেছেন। ২০০৮ সালে পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে এ প্রসঙ্গে জহির বলেন : We landed in Rangamati just after nightfall, the next morning I called on Raja Tridiv Roy, the Chakma Chief, He lived in an old bungalow on an island separated from the mainland by a channel about fifty yards wide. I explained to the Raja that the army had come to re-establish the control of the Pakistan Government on the Hill Tracts and asked for his co-operation in maintaining peace and to keep me informed about any rebel movement, concentration and activity, the Raja agreed and co-operated right up to the surrender. At the request of our government Raja Tridiv Roy came to West Pakistan before our surrender in East Pakistan, he was our ambassador in a number of countries and now lives in Islamabad.
[ ভাবানুবাদ: ভোররাতের দিকে আমরা রাঙ্গামাটিতে পা রাখি, পরদিন চাকমাদের গোষ্ঠীপ্রধান রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে দেখা করি, পঞ্চাশ গজ চওড়া একটা খালের ওপা্রে পুরানো এক বাংলোয় তিনি থাকতেন। আমি রাজাকে বুঝিয়ে বলি যে পার্বত্য অঞ্চলে পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনী এসেছে। এবং শান্তি বজায় রাখতে ও বিদ্রোহীদের (মুক্তিবাহিনীর) চলাচল, জমায়েত আর যে কোনোধরণের তৎপরতার খবর পেতে তার সহায়তা চাইলাম। রাজা রাজী হলেন এবং আমাদের আত্মসমর্পনের আগ পর্যন্ত তার সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের আত্মসমর্পনের আগেই অবশ্য আমাদের সরকারের অনুরোধে পশ্চিম পাকিস্তানে আসেন রাজা ত্রিদিব রায়। অনেকগুলো দেশে তিনি আমাদের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখন ইসলামাবাদে থাকেন।]
রাঙ্গামাটিতে দলবলসহ জহিরের এই আগমন কিন্তু নেহাতই সামরিক আদেশ ছিলো না। আর তার প্রমাণ মিলেছে খোদ ত্রিদিব রায়ের জবানিতে। আত্মজীবনী ‘The Departed Melody’তে জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে তিনি (রাজা ত্রিদিব রায়) তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, মোঃ হজরত আলী এবং আরো কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার-এর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরো কয়েকজন বাঙালি ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবেন। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়।
এই দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসার পক্ষে সাফাই হিসেবে লিখেছেন: Increasing lawlessness and violence of the rebel Bengali forces promised no safety to anyone (Page-214) In Rangamati, from 26 March onward, Awami League cadres, in league with the rebel police and tha East Pakistan Rifles, began rounding up the Biharis (Page-216) . There was a constant supply of food and firearms in commandeered trucks to the Mukti Bahini, comprising rebel EBR (East Bengal Regiment), EPR (East Pakistan Rifles), and the police. These elements were fighting the The Army at Chittagong and elsewhere. People were forced by Awami League cadres to pay money and rice under threat of violence. Many shopkeepers had closed shop and run away. ( Page- 217)
যাদের বিরুদ্ধে তার এই অভিযোগ সেই মুক্তিবাহিনীর মূল নেতৃত্বে ছিলেন জিয়াউর রহমান। তার অন্যতম সঙ্গী ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের স্মৃতিচারণ অনুযায়ী ১১ এপ্রিল পাকিস্তানীদের সাড়াশি আক্রমণের মুখে কালুরঘাট ব্রিজের নিয়ন্ত্রণ হারায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের নিয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী।দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ (৩০ মার্চ জিয়া তাকে কালুরঘাট প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দিয়ে রামগড় চলে যান)। ১২ এপ্রিল তারা পশ্চাদপসরন করে রাঙামাটি এসে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন।আর মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে মহালছড়িতে ব্যাটেলিয়ান হেডকোয়ার্টার, সেখান থেকে একেকজন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলোতে অব্স্থান নেন মুক্তিযোদ্ধারা।এক কোম্পানি যোদ্ধা নিয়ে খাগড়াছড়ি ও রাঙা্মাটির দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের। বুড়িঘাট ও রাঙামাটির মাঝামাঝি অবস্থান নেন খালেকুজ্জামান। লে. মাহফুজ তার ডিফেন্স গড়ে তোলেন বড়কল ও রাঙামাটির মাঝে। সুবেদার মোতালেব দায়িত্ব নেন কুতুবছড়ির। [তথ্যসূত্র: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ : প্রতিরোধের প্রথম প্রহর/ মেজর রফিকুল ইসলাম (পিএসসি)/পৃ: ৪২-৪৭]
এদের ঠেকাতেই ত্রিদিব রায়ের চট্টগ্রাম যাওয়া এবং পাকিস্তানীদের নিয়ে আসা। এই আগমন তার কাছে কিরকম প্রত্যাশিত এবং এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি কতখানি আনন্দিত স্মৃতিকথায় তার বর্ণনাও দিয়েছেন: On the way back, at Ranirhat, 18 miles from Rangamati, a number of very frightened people asked us when the army was going to take over these areas. They said they were suffering at the hands of the Mukti Bahini. We told them that the army would be coming at any moment. That evening at dusk the army, in launches and speedboats made a sort of miniature Normandy landing (the Allied landing in France of 6 June 1944) at Rangamati and swiftly took command of the situation (page-221).
রাজা তার প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন একদম শুরু থেকেই। জহির আলম যে সহযোগিতার কথা লিখেছেন তার মধ্যে রয়েছে একদল মুক্তিযোদ্ধার কথাও, ত্রিদিব রায়ের দেওয়া গোপন খবরে যারা অসহায়ের মতো ধরা পড়েছিলো সেদিনই রাঙামাটিতে পা রাখা পাকিস্তানীদের হাতে। সদ্য ট্রেনিং পাওয়া এই দলটি এসেছিলো মূলত মহালছড়ি ডিফেন্সে সহায়তা করতে। এদের অন্যতম ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশিওলজির ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ইফতিখার (কিছু বইয়ে তার নাম ইফতেখার হিসেবে উল্লেখিত) । মুক্তিযোদ্ধাদের একদম প্রথম ব্যাচে ট্রেনিং নিয়েছিলেন তিনি। বাংলার অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান সেসময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, এফ রহমান হলের প্রভোস্ট ছিলেন তিনি। স্মৃতিকথা ‘আমার একাত্তর’ (সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৭) বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৪৮ এবং ৪৯ পৃষ্টায় ছিলো ইফতিখারের কথা। আনিসুজ্জামানের ভাষায়, ‘রামগড়ে পৌছাবার পরপরই দেখা হয়েছিল আমার হলের আবাসিক ছাত্র ইফতিখারের সঙ্গে। যতদূর মনে পড়ে, সমাজতত্বের ছাত্র ছিল। ওকে মনে রাখার একটা বিশেষ কারণ ঘটেছিল, সেটা আগে বলে নিই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ড্রাইভারের সঙ্গে কয়েকজন ছাত্র দূর্ব্যবহার করেছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে ইফতিখারও ছিল,সে অবশ্য নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছিল। তাকে ভালো করে জেরা করার পর আমি নিঃসংশয় হয়েছিলাম যে ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত ছিল না। …সেই ইফতিখারকে দেখলাম সাবরুমের দিক থেকে রামগড়ে এসে নামলো নৌকা থেকে। আমাকে দেখে সে অভিভূত। বললো, যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে ফিরছে, তারাই প্রথম ব্যাচের। তারপর সে আমার পিছনে লেগে রইলো, সে রাঙামাটিতে গিয়ে যুদ্ধ করতে চায়। তার বাবা সেখানে স্কুলের হেডমাস্টার। রাঙামাটি গিয়ে বাড়ির সকলকে দেখবে এবং যুদ্ধ করে তাদের মুক্ত করে আনবে- এমন ইচ্ছেয় সে টগবগ করছে।তার ধারণা সামরিক কর্তৃপক্ষকে আমি বললেই তার রাঙামাটি যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তাকে যতোই বোঝাতে চাই যে এসব রণকৌশল সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে যাওয়া আমার পক্ষে অসঙ্গত, সে ততোই মিনতি করতে থাকে। তারপর একদিন হঠাৎ আর খোঁজ নেই তার। পরে জানতে পারি সবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে সে শত্রুকবলিত রাঙামাটির দিকেই চলে যায় এবং পাকিস্তানী সেনাদের অ্যামবুশে শহীদ হয়।’
শেষ তথ্যটুকু ভুল। ইফতিখার অ্যামবুশে পড়েছিলেন, কিন্তু সেখানেই শহীদ হননি। তাকে অসম্ভব যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জামাল উদ্দিন ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ (বলাকা প্রকাশনী, ২০১১) বইয়ের ৩৭৯-৩৮০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন সেই অ্যামবুশের, ‘…অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালাল খ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) বিশ্বাসঘাতকতায় ওই দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙ্গামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এ দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গামাটির আবদুল শুক্কুর, এসএম কামাল, শফিকুর রহমান, ইফতেখার, ইলিয়াস, আবদুল বারী, মো. মামুন ও আবুল কালাম আজাদ। ধৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র আবুল কালাম আজাদ ও ফুড ইন্সপেক্টর আবদুল বারী ছাড়া অন্যদের পাকবাহিনী নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে মানিকছড়িতে নিয়ে হত্যা করে।’
আর সেই নির্মম অত্যাচারের ধরণ সম্পর্কে জানা গেছে শরদিন্দু শেখর চাকমার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম’ (অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৬) বইয়ে, ‘রাঙ্গামাটি মহকুমা সদরের এসডিও আবদুল আলী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি স্পিডবোটে করে মহালছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি আসেন।… স্পিডবোটে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা এস এম কালাম, আবদুল শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম, মামুন, সামসুল হক মাস্টার এবং রাঙ্গামাটি হাইস্কুলের তদানীন্তন হেডমাস্টার রহমান আলীর ছেলে ইফতেখার। … এর মধ্যে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য আবদুল আলীকে রাঙ্গামাটিতে পুলিশ লাইনের এক ব্যারাকে আটক করে রেখে তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্লেড দিয়ে আঁচড়ে দেয়া হয়েছিল। এরপর সেসব জায়গায় লবণ দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া তাকে একটি জিপের পেছনে বেঁধে টেনে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছিল’ (পৃ: ২৬-২৭)।
একই বইয়ের ৩০-৩১ পৃষ্ঠায় শরদিন্দু লিখেছেন, ‘…আমি তাকে (রাজা ত্রিদিব রায়) বলি, আমার তো মনে হয় পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে এবং তার পক্ষে স্রোতের বিপরীতে যাওয়া ঠিক হয়নি। রাজা ত্রিদিব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে না, যদি ভারত পাকিস্তানকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে না পারে। আর ভারত পাকিস্তানকে পরাস্ত করতে পারবে না, কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে চীন এবং আমেরিকা রয়েছে। তারা কোনদিন পাকিস্তানকে ভারতের নিকট পরাজিত হতে দেবে না। রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি তিনি তখন পাকিস্তানিদের চেয়ে বেশি পাকিস্তানি হয়েছেন।’
কথাটা ভুল নয়। নিজেকে সাচ্চা পাকিস্তানি হিসেবে প্রমাণের কোনো উপায় বাদ রাখেননি ত্রিদিব রায়। তার নির্দেশ মেনে অনুগত চাকমা ও মিজোদের নিয়ে গড়া ব্রিগেড সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে লড়তে থাকে। মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটির নিয়ন্ত্রন নিতে সাহায্য করে তাদের। মুক্তিবাহিনী একে একে দখল হারায় বিভিন্ন স্থানের। ১৯ এপ্রিল বুড়িরহাটের প্রতিরক্ষা যুদ্ধে শহীদ হন ল্যান্স নায়েক মুনসী আবদুর রউফ (বীরশ্রেষ্ঠ), অসম সাহসিকতায় মৃত্যুবরণ করে প্রাণরক্ষা করেন খালেকুজ্জামানসহ বাকিদের। ২৭ এপ্রিল নানিয়াচর এলাকায় তাদের আক্রমণে শহীদ হন ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের। ২৮ এপ্রিল মগরাজা মংপ্রু সেনের সহায়তায় খাগড়াছড়িতে বিপুল বিক্রমে লড়েও গুলির অভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয় মুক্তিবাহিনী। ২ মে রামগড়েরও পতন ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী নিজে উপস্থিত থেকেও ঠেকাতে পারেননি এর পতন। [ তথ্যসূত্র: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ : প্রতিরোধের প্রথম প্রহর/ মেজর রফিকুল ইসলাম (পিএসসি)/পৃ: ৪২-৪৭ ]
মুক্তিযুদ্ধের প্রায় অনেকখানি সময়ই ত্রিদিব রায় পার্বত্য অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে তার ক্যাম্পেইনিং চালিয়ে গেছেন। তার আহবানে সাড়া দিয়ে দলে দলে চাকমা যুবকেরা ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সে ভর্তি হতে শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বের হওয়া হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র-৯ম খন্ড’ ৯৩ পৃষ্ঠায় মীর শওকত আলীর (বীর উত্তম) উদ্ধৃতিতে লেখা হয়েছে, ‘চাকমা উপজাতিদের সাহায্য হয়ত আমরা পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়।’ এ প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়ন’ বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন, ‘উপজাতীয় যুবকদের কিছুসংখ্যক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও অধিকাংশই পকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত সিভিল আর্মড ফোর্স বা সিএএফ (রাজাকার বাহিনী হিসেবে পরিচিত)-এ যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় অংশ নেয়। তৎকালীন রাজাকার বাহিনীতে চাকমাদের সংখ্যাই বেশি ছিল। অনেকেই বেতন এবং অস্ত্রের লোভে সিএএফে যোগ দেয়। রাজা ত্রিদিব রায় তার সার্কেলে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গিয়ে জনগণকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য প্রচারণা চালাতে থাকেন। চাকমা যুককেরা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, পানছড়ি প্রভৃতি এলাকায় স্থাপিত পাকিস্তানি ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। উপজাতিদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন রাজশাহী বিভাগ থেকে পালিয়ে আসা ইপিআরের হাবিলদার মি. নলিনী রঞ্জন চাকমা এবং হাবিলদার মি. অমৃতলাল চাকমা। এরা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দোভাষীর কাজও করতেন। উপজাতি যুবকেরা টেনিং ক্যাম্প ৩০৩ রাইফেল, কারবাইন, স্টেনগান, এল এম জি চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন।’
অনুগতদের লেলিয়ে দিয়েছেন। তারা পাকিস্তানীদের পথ দেখাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখাচ্ছে, ফাঁদ পেতে ধরতে সাহায্য করছে। আর তিনি অপেক্ষায় আর বড় খেলার। অংশু প্রু চৌধুরীর মতো গভর্নর মালেকের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভায় যোগ দেওয়া তার জন্য অসম্মাণ। নভেম্বরে এলো সেই সম্মাননা। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে তিনটি দেশে সফরে গেলেন রাজা ত্রিদিব রায়। এই সফরের খবর দিয়ে ২৪ নভেম্বর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত হিসেবে ত্রিদিব রায় তিনটি দেশ সফর করিবেন’ শিরোনামে লেখা হয় :পূর্ব পাকিস্তান হইতে নির্বাচিত এমএনএ রাজা ত্রিদিব রায় প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত হিসেবে সিংহল, নেপাল ও থাইল্যান্ড সফর করিতেছেন বলিয়া আজ এখানে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়। রাজা ত্রিদিব রায় এই সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের নিকট পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করিবেন। ইহা ব্যাতীত তিনি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং আমাদের সীমান্তে ভারতীয় সৈন্যদের সমাবেশ ও আমাদের এলাকায় গোলাবর্ষনের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শান্তি ও নিরাপত্তার উপর যে বিপদাশঙ্কা নামিয়া আসিয়াছে সে সম্পর্কেও তাহাদের অভিহিত করিবেন। আজ তিনি এখান হইতে যাত্রা করিয়াছেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন ডিরেক্টরও তাহার সহিত রহিয়াছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, গত ২১ নভেম্বর রাজা ত্রিদিব রায় প্রেসিডেন্টের সহিত সাক্ষাত করেন।(হুবহু উদ্ধৃত)
এই সাক্ষাতের প্রেক্ষাপট রচিত হয় জেনারেল নিয়াজীর পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরে (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ অক্টোবর ১৯৭১)।পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাতকারে (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৬) ত্রিদিব রায় বলেছেন নভেম্বরে তাকে দক্ষিন-এশিয়া সফরে যেতে হবে এটার কথা তিনি আগেই জানতেন। সে উপলক্ষ্যেই ৯ নভেম্বর তিনি রাঙামাটি ছাড়েন। ১০ তারিখ নিয়াজীর এক ভোজসভায় যোগ দেন। তার ভাষায়: Since I was aware of a trip in November 1971 that would take me to South and Southeast Asia, I received a telegraph asking me to report to the foreign office in Dhaka. So I left home on November 9, 1971… The next day, General “Tiger” Niazi invited me to a party of some 100 guests, with Bangla and Urdu songs being sung by local artistes. It was the last big party “Tiger” Niazi held. I flew to Karachi on November 11, and then from there I came to Rawalpindi. At General Yahya’s instructions, the law minister, (late) Justice Cornellius, agreed to incorporate the Chittagong Hill Tracts as a Federally Administered Tribal Area (Fata). I was happy at the outcome since my dream had come true but it was already too late, as we now know through hindsight.
শ্রীলঙ্কা দিয়ে শুরু হয়ে ত্রিদিবের সফর। ২৬ নভেম্বর কলম্বোর মার্কিন দূতাবাদ থেকে পাঠানো এক তারবার্তায় বিস্তারিত বর্ণনার আগে সারমর্ম হিসেবে লেখা হয়েছে : Raja Tridiv Roy in Ceylon as representative of GOP President Khan. Main thrust of mission seems aimed at Ceylon’s Buddhist majority. Roy suggests Pakistan would welcome Bandaranaike’s involvement in Indo-Pak dispute. Local interest in dispute running quite high… একই তারবার্তায় তার এই সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথাও লেখা হয়েছে যেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, গণহত্যা-ধর্ষণের সাফাই গাওয়া একজন লোক কিভাবে শান্তিবাদী বৌদ্ধধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে!…Roy visit seems to be bringing Pakistan question back to front burner in local debates. Group calling itself Ceylon Committee for Human Rights in Bangla Desh was refused interview with Roy and promptly branded him quote an outcast.. .who cannot reconcile the teachings of the compassionate Buddha with murder, rape and pillage by the military clique whose cause he had come here to espouse…
ত্রিদিবকে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিলো। ডনকে দেওয়া প্রাগুক্ত সাক্ষাতকারে ত্রিদিব রায় জানাচ্ছেন থাইল্যান্ড সফরের সময় ব্যাংককে খুররম খান পন্নী তাকে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করার প্রস্তাব দেন। পন্নী তখন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে ফিলিপাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু ত্রিদিব রায় দৃঢ়ভাবে তাকে প্রত্যাখান করেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে তার সেই বড়াইপনার বয়ান এরকম: I was designated a special envoy, ambassador extraordinary and plenipotentiary, and began my tour. When I was in Thailand on December 3, 1971, the Pakistan ambassador, K.K. Panni, from East Pakistan who had turned hostile and had designated himself as the Bangladeshi Ambassador of the Philippines, visited Bangkok and offered inducements to forswear my allegiance to Pakistan. I did not comply but retorted, “don’t you think these suggestions to a representative of Pakistan are improper?” I told him point-blank that I would not defect.
পদের ভারে মোহাবিষ্ট ত্রিদিব রায় কারো কথাই শোনেননি। এমনকি তার মায়েরও না। ’৭২ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ চেয়ে বাংলাদেশের আবেদন ঠেকাতে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার মা বিনীতা রায়কে নিউইয়র্কে পাঠান ছেলেকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ফিরিয়ে আনতে। ত্রিদিব তাকেও প্রত্যাখান করেন। তারপর সাফল্যের সঙ্গে মিশন শেষ করে রেডকার্পেট অভ্যর্থনা পান। তাকে স্বাগত জানাতে পুরো মন্ত্রীপরিষদসহ বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন এ বিষয়ে ডন পত্রিকায় তার কূটনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণ নিয়ে লেখা স্মৃতিকথা সাউথ আমেরিকান ডায়েরিজের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়েছে : He did not learn diplomatic skills in an academy; in all probability he acquired the knack of diplomacy during his first appearance at the historic United Nations session in 1972. He was sent to the United Nations` headquarters to lead the Pakistani delegation and defeat the resolution on Bangladesh`s application for membership.
At the same time, President Sheikh Mujibur Rehman of Bangladesh dispatched Roy`s mother to New York with a mandate that she should prevail on her son to forswear his loyalty, embarrass Pakistan and gain the new state admission into the UN.
It was a critical situation for Roy to first convince his own mother about the correctness of the Pakistani stand that it was not the right time for Bangladesh to aspire for UN membership because it remained India`s client state since the Indians were still stationed there.
His mother`s pleading notwithstanding, he was able to `grasp the practicalities of diplomacy in a multilateral setting` and came out shining through the ordeal and completed the assignment as well as any trusted Pakistani diplomat would. In recognition of a job well done, Prime Minister Zulfikar Ali Bhutto greeted Roy on his return at Chaklala airport in Rawalpindi with a protocol fit for a head of state.
আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে ত্রিদিবের এই স্মৃতিকথায়। ভুট্টো নাকি তাকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তবে পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী সেজন্য তাকে মুসলমান হতে হবে! ধর্মান্তরিত হওয়ার ওই প্রস্তাবে ত্রিদিব সায় দেননি। দিলে নেহাত মন্দ হতো না।
ঘাতক-দালাল শিরোমনি গোলাম আযমের মতো ত্রিদিবেরও নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছিলো সরকার (১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় একটি তালিকা ছাপা হয় যেখানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সহায়তার অভিযোগে দালাল আইনে অভিযুক্তদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয় নুরুল আমিন, সবুর খান,গোলাম আযমসহ দালালদের সে তালিকায় ৮ নম্বরে ছিলো ত্রিদিব রায়ের নাম)। তাতে থোড়াই এসেগেছে তার। গোলামের মতো ত্রিদিব রায়ও বসে থাকেননি। পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য আর বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বেষ সমানে চালিয়ে গেছেন।পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে তার ও তার অনুগতদের ইন্ধন নিয়ে ’৭৩ সালে পত্রিকায় সিরিজ রিপোর্ট হয়েছে। সেই লোকটা মরে গেছে। পাকিস্তানের একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবেই মৃত্যু হয়েছে তার। কিন্তু বাঙালীদের চোখে একজন পাকিস্তানী দালাল হিসেবে, যার ক্ষমা মৃত্যুতেও নেই। দেশে যে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে,যেই অপরাধে গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদরা বিচারের সম্মুখীন, সেই একই অপরাধে অপরাধী রাজা ত্রিদিব রায়ও। তার হাতে লেগে আছে বীরশ্রেষ্ট মুন্সী আবদুর রউফের রক্ত। ইফতেখার, শুক্কুর, কামাল, শফিক, ইলিয়াস, মামুনদের নৃশংস হত্যায় সহযোগিতার দায় তার কাঁধেও। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশে গণহত্যা-ধর্ষণ-বাঙালীদের বাস্তুহারা করার পক্ষে সাফাই গাওয়ার অপরাধ তার প্রমাণিত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার পুরস্কার ভোগ করা এবং আজীবন পাকিস্তানী থেকে মৃত্যুবরণ করা একজনকে এই বাংলার মাটিতে সমাহিত করতে দেওয়াটা হয়তো চাকমাদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষিতে মানবিক, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে পাশবিক। সবক্ষেত্রেই তার যোগ্যতা হিসেবে দেখানো হয়েছে ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে, সেই আওয়ামী লীগ, ৭০এর নির্বাচনের প্রেক্ষিতে যে ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্তরাধিকার বয়ে বেড়ায়, ঠিক কিভাবে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে তার পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। এমন সিদ্ধান্ত যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বুড়ো আঙ্গুল শুধু দেখায়নি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিকও। এ আমাদের তিরিশ লাখ শহীদ এবং লাখো বীরাঙ্গনার অপমানকে উপহাস। সরকারের এই সিদ্ধান্তে তীব্র ধিক্কার এবং তা বাস্তবায়ন প্রতিরোধের ঘোষণাও আমার এই প্রতিবাদ।
শেষ কথা: ত্রিদিব রায়ের অরবিচুয়ারিতে এক পাকিস্তানী নীচের কথাগুলো লিখছেন:
…I am a Pakistani and feel proud to be one of the citizen of the great country on the earth. But, the way this newspaper is trying to glorify Tridib Roy is not only surprising but simply objectionable. Raja Tridib was the real “Traitor” who betrayed Bangladesh during 1971. And remember, a person, who is able to betray his country, he is also able to betray any one.
Thanks to Allah that he is dead. He might be hero for us or we can thank him the way he betrayed our enemy but do not feel too much for him. When a son betray his mother and take a shelter under his mother’s enemy, then remember,
“He was never for his mother nor for his enemy”. He is a real loser. …
আফসোস, জীবদ্দশায় এই কথাগুলা পড়ার সুযোগ হলে, জায়গায় মৃত্যু হতো ত্রিদিবের।
ছবি:
১.জাতিসংঘ মিশন থেকে পাকিস্তানে ফেরার পর বিমানবন্দরে ভুট্টোর অভ্যর্থনা
২. ৭৩ সালে দৈনিক আজাদের সিরিজের কোলাজ
৩. পাকিস্তানের মন্ত্রীসভায় ত্রিদিব রায়
কিছু তথ্যের কৃতজ্ঞতা: আরাফাতুর রহমান ও সৈয়দ ইবনে রহমত
লেখকঃ অমি রহমান পিয়াল