ব্যাংকক টু লিবিয়া : মার্কিন দলিলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দেশত্যাগ ও পুনর্বাসন-১

ব্যাংকক টু লিবিয়া : মার্কিন দলিলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দেশত্যাগ ও পুনর্বাসন-১

 

[ ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর ভোরে ব্যাংককে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইট ল্যান্ড করে। এসটু-এবিও (S2-ABO) নাম্বারধারী এই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসার, তাদের অধঃস্থন এবং পরিবার। সব মিলিয়ে ২৯ জন।

এই সেনাসদস্যরা মাস কয়েক আগে এক নির্মম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে লাইমলাইটে আসেন। অভ্যুত্থানের নামে ১৫ আগস্টের সে হত্যাকান্ডের শিকার হন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যরা। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও যুবলীগ নেতা ফজলুল হক মনি এবং ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতও এ হত্যাযজ্ঞের শিকার হন, প্রাণ দেয় তাদের পরিবারেরও কয়েকজন সদস্য। খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে ‘মেজর’ র‌্যাংকের এই অফিসারদের দেশ-শাসন শেষ হয় তার আগের দিন, ৩ নভেম্বর। সেদিন অভ্যুত্থান করেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। এরপর এক সমঝোতার মাধ্যমেই দেশত্যাগ করতে দেওয়া হয় ওই খুনী অফিসারদের। এর মাঝে আগে এবং পরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলেও এই পোস্টের ফোকাসটা থাকবে শুধু মাত্র দেশত্যাগী অফিসারদের ওপর। ঢাকা থেকে ব্যাংকক তারপর যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে তাদের প্রত্যাশিত রাজনৈতিক আশ্রয় লাভে ব্যর্থ হওয়া এবং আকস্মিকভাবেই লিবিয়ার দরজা খুলে যাওয়ার নেপথ্য ঘটনাগুলো ধারাবাহিক বলা হয়েছে অনেকটা গল্পের আদলে।

এসব তথ্যের উৎস সেসময়কার মার্কিন দূতাবাসের তারবার্তা। ঢাকা, রেঙ্গুন, ব্যাংকক, ইসলামাবাদ, বেনগাজী এবং লন্ডনের মার্কিন দূতাবাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কিছু সম্পূরক তারবার্তাকে অবলম্বন করে তিন সপ্তাহের ঘটনাপঞ্জী সংকলিত হয়েছে। আর কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে রাখা হয়েছে ঢাকার সে সময়কার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারকে, বর্ণনায় তাকে বেশ নিরীহ ঠেকতে পারে। উল্টোটাই সত্যি। ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে ৭ নভেম্বর, জিয়াকে ভালোমতো প্রতিষ্ঠা করেই তবে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন তিনি । পোস্টে ঘটনা সংশ্লিষ্ট অন্য উপাত্তও ব্যবহার করেছি বর্ণনার স্বার্থেই। এবং লিবিয়াতেই থেমে না থেকে তার পরের কিছু তৎপরতাও যোগ করা হয়েছে পাঠকের কৌতুহলের খানিকটা নিবৃত্তি দিতেই। মূল তারবার্তাগুলোর লিংকও সংযুক্ত করা হয়েছে যাতে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে।]

ডেভিড ইউজিন বোস্টার (বায়ে) ও হেনরি কিসিঞ্জার
ডেভিড ইউজিন বোস্টার (বায়ে) ও হেনরি কিসিঞ্জার

৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ 

এক.

ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। সাতসকালেই ফোন বেজে উঠলো ইউজিন বোস্টারের। ঘড়ি দেখলেন রাষ্ট্রদূত, সকাল ৮ টা ১০ মিনিট। দূতাবাসের সিনিয়র স্টাফদের সঙ্গে এক জরুরী বৈঠক চলছে তার। ঢাকায় আবার অভ্যুত্থান ঘটেছে। এবার খালেদ মোশাররফ। জোরালো আওয়াজে আকাশে টহল দিচ্ছে বিমান বাহিনীর একটি মিগ। দূতাবাসের একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে মেশিনগান আর রকেট সজ্জিত একটি হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। ফোন ধরলেন বোস্টার, করেছেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তোতলাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। সংক্ষিপ্ত আলাপে যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে খালেদ মোশাররফ ঝামেলাটা পাকিয়েছেন। তার শখ সেনাপ্রধান হওয়া। আরও গোটাতিনেক দাবিও আছে। তো ঠিকাছে সেজন্য সামনে আসো কথা বলি, আলোচনা করি। না, সে শক্তি দেখাচ্ছে, মহড়া দিচ্ছে। আমার ধারণা সোভিয়েতরা ওর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে। ভারতও আছে। তো বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে ভাবলাম আপনাদের ব্যাপারটা জানাই। আপনারা যা ভালো মনে করবেন তাই করবেন। তবে রক্তপাত যেন না হয়। মোশতাককে শুভেচ্ছা জানিয়ে বোস্টার ফোন রাখলেন। তারপর প্রথম তারবার্তাটি পাঠালেন যার শিরোনাম প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদের সাহায্যের আকুতি। সকাল বলছে দিনটা ব্যস্ত যাবে বোস্টারের।সোভিয়েত এবং ভারতীয় ইন্ধনের অনুমান সত্যি নয়। এমন কোনো আভাস মেলেনি গোয়েন্দা তরফে। তারপরও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে তাদের সংযম দেখানোর অনুরোধ করলেন বোস্টার তার বার্তায়। প্রাপক সেক্রেটারি অব স্টেট। প্রেসিডেন্ট নয়, গোটা বিশ্বকে চালান এই সেক্রেটারি অব স্টেট। হেনরি কিসিঞ্জার। আগের টেলিগ্রামেই জানিয়েছেন, দুতাবাস তার জরুরী পরিকল্পনামতোই কাজ করছে।

বোস্টারের টেলিগ্রাম 

বোস্টারের টেলিগ্রাম

দুই.

সকালের অসহায় ভাবটা অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছেন খন্দকার মোশতাক। নিজেকে যে সামলে নিয়েছেন তা বোঝা গেলো দুপুরে। এবারের ফোনটা এলো প্রোটকল মেনে। করেছেন মাহবুবুল আলম চাষী, রাষ্ট্রপতির মূখ্য সচিব। ২টা ২০ মিনিটে করা তার প্রথম ফোনে সরাসরিই কথা পাড়লেন চাষী। রাষ্ট্রপতি মোশতাক তাকে খোঁজ নিয়ে জানতে বলেছেন যদি পরিস্থিতি সেরকম হয় তাহলে ‘বাংলাদেশের বিশেষ কিছু ব্যক্তিকে’ রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা। বোস্টার জিজ্ঞাস করলেন, আপনি কি দুই মেজরের (ফারুক-রশীদ) কথা বলছেন? উত্তর এলো- হ্যা। বোস্টার ফরেন অফিস ম্যানুয়েল থেকেই আউরে গেলেন- বিদেশে কাউকে সাধারণত আমরা রাজনৈতিক আশ্রয় দিই না। তবে যেহেতু পরিস্থিতি গুরুতর এবং আপনি প্রেসিডেন্টের অনুরোধ পালন করছেন আমি চূড়ান্ত কোনো কথা দিতে না পারলেও দেখছি ব্যাপারটা কি করা যায়। চাষী যোগ করলেন-সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে,ওরা বেশ গ্যাড়াকলের মধ্যে পড়ে গেছে। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই যা করার করতে হবে। বোমাটা ফাটলো এরপর-রাষ্ট্রপতি নিজেও তাদের সঙ্গী হতে পারেন। বোস্টার নিশ্চিত হতেই প্রশ্ন করলেন- কি বললেন? আবার বলেন? চাষী এবার ভেঙ্গে বললেন- ওই একই সময় রাষ্ট্রপতি নিজেও রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন জানাতে পারেন। সেইসঙ্গে তার কিছু সতীর্থও। সে তালিকায় ওসমানী থেকে শুরু করে খলিল, জিয়া- যে কেউ কিংবা সবাই থাকতে পারেন।

বোস্টারের টেলিগ্রাম

তিন.

পাঁচ মিনিট পর (দুপুর ২টা ২৫ মিনিট) চাষী আবারও ফোন করলেন প্রস্তাবনাটির ব্যাখ্যা দিতে। এ মুহূর্তে তারা সমঝোতামূলক আলোচনায় আছেন খালেদ মোশাররফের দলের সঙ্গে। সেখানে নানা শর্তাদির মধ্যেই প্রস্তাবটি তারা রাখছেন।তারা চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে কোথায় আপতকালীন আশ্রয়। তারপর তৃতীয় কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় যেটা যুক্তরাষ্ট্র হওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়। এবং তাদের পছন্দ যুক্তরাজ্য (ইউকে)।এ বিষয়ে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কিনা প্রশ্ন করলেন বোস্টার। চাষী বিনয় নিয়েই বললেন যে অতীতে রাষ্ট্রপতি (মোশতাক) ও তার সরকারের প্রতি যে গভীর সহানুভূতি দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তার প্রেক্ষিতেই নিশ্চিত ভরসার খোজে এই একমাত্র আবেদন, শুধু তার কাছেই। বোস্টার গললেন কিনা বোঝা গেলো না, শুধু বললেন, ঠিকাছে, হাতে সময় খুবই কম। আমি দেখছি দ্রুত কিছু করা যায় কিনা, তারপর জানাচ্ছি আপনাকে। এরপর একটি ফ্লাশ ম্যাসেজ পাঠালেন দেশে- প্রেসিডেন্ট মোশতাক, দুই মেজর এবং প্রেসিডেন্টের কিছু সহযোগীর জন্য সম্ভাব্য রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করা হয়েছে। আগামী তিন ঘণ্টার মধ্যে সন্তোষজনক কোনো উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দেশনা চাইছি।

 

চার.

রাত সাড়ে আটটায় বোস্টারের সঙ্গে আবার কথা হলো চাষীর। বোস্টারই ফোন করেছিলেন। খানিক আগে নতুন সরকারের চীফ অব প্রটোকল তাকে জানিয়েছেন মেজরদের দেশত্যাগের ব্যাপারে গ্রিন সিগনাল দেওয়া হয়েছে, তবে তালিকায় শুধু সেনা সদস্যরাই রয়েছেন। বোস্টার জানতে চাইলেন ব্যাপারটা, শুধু মেজররা যাচ্ছে, পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা। চাষী জানালেন মেজররা পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই যাচ্ছেন এবং এক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার দিকটা যুক্তরাষ্ট্রকেই দেখতে হবে আগের প্রস্তাবনামতোই। বোস্টার সরাসরি কথায় এলেন, মোশতাকের ব্যাপারটা কি! রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের ব্যাপারটা কি তিনি আর বিবেচনা করছেন না? চাষী এবার একটু বিব্রত। ব্যাপারটা নির্ভর করছে ‘যারা দেশ চালাচ্ছেন’ তাদের মর্জির উপর। ‘যারা দেশ চালাচ্ছেন’ মানে! একটু অবাকই হলেন বোস্টার। চাষী শুধু বললেন, এর বেশী আমি বলতে পারছি না। আসল কথা হচ্ছে এমন কোনো প্রস্তাবে আপনারা বিব্রত না হলেই হয়। টেলিফোন রেখে বোস্টার আবার একটি জরুরী বার্তা পাঠালেন। ‘রাষ্ট্রপতির সম্ভাব্য রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুরোধ’ শিরোনামের ওই টেলিগ্রামে চাষীর সঙ্গে তার কথাবার্তার খুটিনাটি উল্লেখ শেষে লিখলেন ‘মূল প্রস্তাবনার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতির সম্ভাব্য রাজনৈতিক আশ্রয়ে আমাদের সহায়তায় করণীয় সম্পর্কে আমার এখনও জরুরী ভিত্তিতে নির্দেশনা প্রয়োজন’।

বোস্টারের টেলিগ্রাম

নোট: গুরুত্ব অনুযায়ী মূল টেলিগ্রামের পাশাপাশি সম্পূরক কিছু বার্তাও পাঠানো হয়।এগুলোকে বলা হয় রেফারেন্স টেলিগ্রাম বা রেফটেল। আবার একটা নির্দিষ্ট ইস্যুকে একটা নাম্বারিং করেও এই রেফটেল পাঠানো হয়, মানে এই রাজনৈতিক আশ্রয় ইস্যুতে প্রতিটি টেলিগ্রামই রেফটেল। খালেদের ক্যু সংক্রান্ত তারবার্তাগুলোর সঙ্গে এগুলো সাংঘর্ষিক নয় বরং পরিপূরক। আরেকটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে প্রতিটি টেলিগ্রাম শুধু পররাষ্ট্র দপ্তরে কিসিঞ্জারকেই পাঠানো হয়েছে তা নয়। এগুলোর প্রতিটি সিসি হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রধান বা কমান্ডার ইন চিফ প্যাসিফিকের কাছে।সংক্ষেপে যা CINCPAC। সেইসঙ্গে সিআইএ, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি, ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স, এইড ইত্যাদি শাখাতেও। প্রয়োজন বুঝে।

খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধানের ব্যাজ পড়াচ্ছেন বিমান বাহিনী প্রধান এমএজি তোয়াব (বায়ে) ও নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খান
খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধানের ব্যাজ পড়াচ্ছেন বিমান বাহিনী প্রধান এমএজি তোয়াব (বায়ে) ও নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খান

পাঁচ.

বার্তা শিরোনাম : বাংলাদেশে ঝামেলা। এটি মূলত খালেদের ক্যু বিষয়ক। আমাদের পোস্টের প্রাসঙ্গিক কথাগুলো এই তারবার্তায় এরকম: বঙ্গভবন এবং ঢাকা সেনানিবাসের মধ্যেকার সমঝোতায় দিনের সংকটের আংশিক সমাধান হলেও মিলেছে। এই মুহূর্তে ১৫ আগস্টের মূল অংশগ্রহনকারীদের বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককে পাঠানোর তোড়জোর চলছে, যাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মেজর ফারুক রহমান এবং খন্দকার আবদুর রশীদ। যা বুঝলাম মোশতাককে হয়তো তার দায়িত্বে রেখে দেওয়া হবে কিন্তু তা সত্যি হলেও তার ক্ষমতার কার্যকারিতা নাটকীয়ভাবেই হ্রাস পাবে। তবে এ মুহূর্তের ঘটনার যা গতিবিধি, তা ঠিকমতো চললে খুব শিগগিরই হয়তো স্বাভাবিক পরিবেশ ফেরত আসবে।…’ বোস্টার এই টেলিগ্রাম পাঠাতে না পাঠাতেই নতুন সংকটের শুরু। রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) থেকে রাষ্ট্রদূত ওসবোর্নের বার্তা। বাংলাদেশ সেনাসদস্যদের বিশেষ ফ্লাইটটির জন্য বার্মার (মায়ানমার) আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে। কিন্তু বার্মিজ কর্তৃপক্ষ ঘটনা জানতে চায়। পুরো তথ্য তাদের না জানানো পর্যন্ত অনুমতি দিতে নারাজ তারা। সম্ভাব্য সমাধানটা ওসবোর্নই দিয়েছেন। ইমার্জেন্সি মার্সি ফ্লাইট। বিপন্ন শিশু ও নারীদের বহনকারী এমন প্রচুর বিমান সদ্য মার্কিন রাহুমুক্ত ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওস থেকে উড়েছে। কোনো দেশই তাদের যাত্রাপথে বাধা দেয়নি। ওসবোর্ন লিখেছেন দুতাবাস বার্মিজ এয়ারমিনিস্ট্রির সঙ্গে টেলিযোগাযোগ রক্ষা করছে। এখন অনুমতিটা আদায় করতে তাদের ঠিক কি বলা যায় সে পরামর্শ চাইছেন। বোস্টার কোনো ঘোরপ্যাচে গেলেন না, বার্মা এবং থাইল্যান্ডের দুতাবাসের বরাতে বার্তা দিলেন: এর আগে পাঠানো অনুরোধসূচক বার্তাটির গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করতেই আপনাদের জানাচ্ছি যে চিফ অব প্রটোকল স্পষ্ট কিছু না বললেও আমরা বিশ্বাসযোগ্য অন্যান্য সূত্রে নিশ্চিত হয়েছি যাত্রীরা সব সেনাকর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্য যারা প্রেসিডেন্ট মোশতাক এবং বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেকার সমঝোতার অংশ হিসেবেই দেশত্যাগ করছেন।

বোস্টারের টেলিগ্রাম
ওসবোর্নের টেলিগ্রাম
বোস্টারের টেলিগ্রাম 

[ নোট: চীফ অব প্রটোকল মূলত পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি পদ যার মূল কাজ রাষ্ট্রের বিদেশী অতিথিদের সফরসূচী নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন। তারবার্তায় তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু দুটো ভিন্নসূত্র নিশ্চিত করেছে মেজরদের এই যাত্রার ভিসা অনুমোদন করানো থেকে শুরু করে গন্তব্যে পৌছানো পর্যন্ত যাবতীয় দায়িত্ব ছিলো এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবের উপর। এখন পর্যন্ত আলোচনায় দুটো ব্যাপার কৌতুহল জাগাতেই পারে। মোশতাক ও খালেদ মোশাররফ গ্রুপের মধ্যেকার সমঝোতা আলোচনার ধরণ এবং দেশত্যাগের প্রস্তাবনা। এ প্রসঙ্গে আমরা তিনটি আলাদা সূত্রে এ নিয়ে জানার চেষ্টা করবো। এক. খুনী মেজরদের একজন শরিফুল হক ডালিমের বক্তব্য (আমি মেজর ডালিম বলছি), দুই, অভ্যুত্থানে মূল ভূমিকা পালন করা এবং খালেদ মোশাররফের প্রধান সহযোগী কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিলের বক্তব্য (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর) এবং লে.কর্নেল (অবঃ) এমএ হামিদের (তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা)।

সমঝোতার প্রক্রিয়া নিয়ে তারবার্তায় বোস্টার যেমন বলেছেন ‘বঙ্গভবন ও ঢাকা সেনানিবাসের মধ্যেকার সমঝোতা’ বাস্তবেও ঠিক তাই ছিলো পরিস্থিতি। পরস্পরের মুখোমুখি না হয়ে তারা টেলিফোনে সমঝোতা চালিয়ে গেছেন সারাদিন!এবং শুরুতেই মোস্তাক যেমন বলেছিলেন খালেদ সেনাপ্রধান হতে চায় এবং আরো তিন-চারটা দাবি আছে ওদের, সেটাও সমর্থিত হয়েছে তিনটি সূত্রেই। তবে বাকি দাবিগুলোর মধ্যে মূল যেটা- ১৫ আগস্টের ঘটনায় জড়িত সব অফিসারসহ আর্টিলারি এবং ল্যান্সার ইউনিটগুলোকে সেনানিবাসে ফিরে আসতে হবে। আর এটাই দেশত্যাগের বিকল্প শর্তটি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে মেজরদের তরফে। দাবিদাওয়া নিয়ে খালেদের প্রতিনিধিদল (কর্নেল মালেক, কর্নেল মান্নাফ ও কর্নেল চিশতী) বঙ্গভবনে গিয়েছিলো। এর বাইরে দেশত্যাগের অনুমতিটাও ফোনেই দেওয়া হয়েছে। মোশতাকের মুখোমুখি শাফায়েতরা হয়েছেন ৫ নভেম্বর।

৪ নভেম্বরের দৈনিক বাংলা
৪ নভেম্বরের দৈনিক বাংলা

এমএ হামিদ জানাচ্ছেন, প্রতিনিধিদের দাবি শুনে রশীদই প্রথম নাকি মোশতাককে প্রস্তাব দেন এই বলে যে ‘স্যার আমরা কিছুতেই ওখানে ফিরে যাব না। এরচেয়ে বরং আমাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন।’ ফারুক রাজী ছিলেন না, তাকে বুঝিয়ে রাজী করান রশীদ। এবং মোশতাকও তাদের সঙ্গে যাওয়ার অভিপ্রায় জানান। মোশতাক মেজরদের দেশত্যাগ করার প্রস্তাব দেওয়ার পর সেনানিবাসে খালেদ মোশাররফ ও তার সহযোগীরা মিটিং করে তাতে সায় দেন এবং বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে তেজগাঁ থেকে আকাশে ওড়ে বিমান। চট্টগ্রামে রিফুয়েলিংয়ের পর সেটা থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছাড়ে। আমার ধারণা চট্টগ্রামে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে বার্মার আকাশসীমা নিয়ে অনুমতি পাওয়ার জটিলতায়। নইলে ব্যাংককে ভোরবেলা ল্যান্ড করার কথা নয়। যাত্রাপথটা বড়জোর দুঘণ্টা সময়সীমার।

৪ নভেম্বরের ইত্তেফাক
৪ নভেম্বরের ইত্তেফাক

শাফায়েতের বক্তব্য ৩ নভেম্বর সকাল থেকে শুরু হয় টেলিফোনে দুপক্ষের বাকযুদ্ধ। আর তাতে পরাজয় মেনে খুনীরা বিদেশ চলে যাওয়া ইচ্ছা প্রকাশ করে। গুরুত্বপূর্ন তথ্য হচ্ছে, শাফায়েত লিখেছেন সেদিন দুপুরের পর তাদের প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে আলোচনার জন্য যায়। এবং সেফ প্যাসেজের প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন ওসমানী। আর তোয়াবকে দেওয়া হয় তা দেখভালের দায়িত্ব। শাফায়েতের শুরুর বাগাড়ম্বরে যদি হাসি এসে থাকে তাহলে ডালিমের বয়ান আপনার হার্টের সমস্যা করতে পারে। তিনি সেনানিবাসে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে খালেদদের মৃদু ধমক-টমক দিয়েছেন। তারপর প্রতিনিধিদের (ডালিম দুজনের কথা বলেছেন মান্নাফ এবং মালেক) নিয়ে বঙ্গভবনে এসেছেন। এবং তাদের এই যাওয়া বিপ্লবী সেনা পরিষদের কৌশলগত সিদ্ধান্ত। অভ্যুথানের মাধ্যমে খালেদকে উৎখাত করে জিয়াকে রি-ইনস্টল করার লক্ষ্যেই তাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রাখা। এবং যাওয়ার আগে খালেদ মোশাররফকে ফোন করে তার দোয়া নেন ডালিম। খালেদ দ্বিতীয়বারের মতো জানান (প্রথমবার সেনানিবাসে) ফারুক রশীদ ছাড়া বাকি সবাই তার চোখে দেশপ্রেমিক, তাদের এই দেশত্যাগ তিনি মেনে নিতে পারছেন না। ডালিম জানাচ্ছেন, রাত সাড়ে দশটায় তাদের নিয়ে প্লেনটি বাংলাদেশ ছাড়ে। ডালিমের সব কিছুতেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূখ্য ভূমিকা পালন করা হিসেবে উপস্থাপনের দাবিটা ওভারলুক করা গেলে মেমোয়ারটিতে ইন্ট্রেস্টিং অনেক তথ্যই মেলে। সবচেয়ে চমকপ্রদটি হচ্ছে মোশতাক-খালেদ মধ্যস্থতা ও সমঝোতামূলক আলোচনায় বঙ্গভবনে কর্নেল তাহেরের উপস্থিতি।

অবাক হওয়ার উপলক্ষ্য কিন্তু এখানেই শেষ নয়। চার তারিখে কোনো পত্রিকাতেই কোনো খবর এলো না। না খালেদের অভ্যুত্থানের না মেজরদের দেশত্যাগের। দৈনিক বাংলায় পানামার জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে মোশতাকের একটি বাণী ছাপা হলো প্রথম পৃষ্টায় এক কলাম কয়েক ইঞ্চিতে। আর ইত্তেফাকের কোথাও চিহ্নমাত্র নেই কারো। যেন বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে কোনো সরকার নেই।]

(চলবে)

[লিংক ছাড়া এই পোস্টের কোনো অংশ লেখকের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। তেমন ঘটনা ঘটলে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে]

লেখকঃ অমি রহমান পিয়াল