একজন অরুন নন্দী ও একটি বিশ্বরেকর্ডের গল্প

একজন অরুন নন্দী ও একটি বিশ্বরেকর্ডের গল্প

 

১৯৭১-এর মাঝামাঝি একটা সময়। মুক্তিযুদ্ধের তখন উত্তুঙ্গ পর্যায়। প্রতিদিন শয়ে শয়ে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং শেষ করে জন্মভূমিতে ফিরে যাচ্ছেন মাকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞাপূরণে। কলকাতার বুকে শরণার্থীদের একজন অরুন নন্দী সিদ্ধান্ত নিলেন দেশের জন্য অন্যরকম কিছু করার। বন্দুক হাতে যুদ্ধ করার সামর্থ্য তার আছে। তবে তারচেয়েও বড় এক প্রতিভা দিয়েছেন তাকে ঈশ্বর। সাঁতার। অবিরাম সাঁতরে যাওয়ার বিরল ক্ষমতা। চাঁদপুরের ছেলে তিনি। পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমেই সাঁতার কেটে মানুষ।

পরিকল্পনা নিয়ে দেখা করলেন দূরপাল্লার সাঁতারের কিংবদন্তী এবং গুরু ব্রজেন দাসের সঙ্গে। বিক্রমপুরের কৃতি সাঁতারু ব্রজেন দাস প্রথম এশিয়ান হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। এবং একাধিকবার। পাশাপাশি ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে পাকিস্তান সাঁতার দলের সদস্যও ছিলেন তিনি। অরুনের বুকের মধ্যেকার আগুনটা টের পেলেন ব্রজেন দাস। রাজী হলেন তাকে সাহায্য করতে। ব্রজেন দাসের তত্বাবধানেই বৌবাজার জিমনেসিয়ামে কঠোর ট্রেনিংয়ে নামলেন অরুন।

এখানে পরিকল্পনাটা খোলাসা করা দরকার। দূরপাল্লার সাতারু হলেও সেরকম কোনো ইভেন্ট সেসময় তার হাতের কাছে ছিলো না। এবং তাতে অংশ নেওয়াও তার জন্য সহজসাধ্য হতো না। আর ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে হলেও চাই যথেষ্ট সময় এবং পর্যাপ্ত অনুশীলন। তাই অরুন নন্দী ঠিক করলেন সাধ্যের মধ্যে থাকা পরীক্ষাটায় উৎরানোর, সেটা একটানা সাতার। যাকে বলে এনডিউরেন্স সুইমিং। এ ক্ষেত্রে তখন বিশ্বরেকর্ড ছিলো বি.সি মোরের। ৮৮ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট একটানা সাঁতরে এই বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন মার্কিন সাঁতারু মোর। অরুন সিদ্ধান্ত নিলেন তার রেকর্ডটাই ভাঙার।

১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর সকাল সাড়ে আটটায় কলকাতা কলেজ স্কোয়ারের পুকুরে নামলেন অরুন। কলকাতার চাঁদপুর সম্মিলনী এবং বৌ-বাজার ব্যায়াম সমিতির এই যৌথ আয়োজনের উদ্বোধন করলেন কলকাতায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার হোসেন আলী। ম্যানেজার হিসেবে ব্রজেন দাস আছেন। কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে অরুনকে উদ্ধারের জন্য তৈরি ভারতের তিন কৃতি সাতারু পিকে সরকার, দিলীপ দে ও পরেশ দত্ত। আটটা পয়ত্রিশ মিনিটে শুরু করলেন। সাঁতরে চললেন অরুন বিরামহীন। সুর্যোদয় ও সুর্যাস্তের মাঝে, গভীর সুনসান রাতে পানিতে ডানা ঝাপটান এক জলাশ্রয়ী মুক্তিযোদ্ধা।

১২ অক্টোবর রাত ২টা ৪০ মিনিটে থামলেন অরুন। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা পানি থেকে তুলে মাটিতে এলিয়ে দেওয়ার আগে স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন- জয় বাংলা। স্টপওয়াচ দেখাচ্ছে ৯০ ঘন্টা ৫ মিনিট টানা সাঁতার কেটেছেন অরুন এই হালছাড়ার আগে। বিসি মোরের বিশ্বরেকর্ড ভেঙ্গেছেন আরো ঘণ্টাখানেক হলো! ছুটে এলেন যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন এবং মন্ত্রী কামরুজ্জামান। সেই বিশ্বরেকর্ডের সাক্ষী হলেন কিংবদন্তীর নায়ক উত্তম কুমার এবং অস্কারবিজয়ী চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়। বাংলা নামে একটা দেশ স্বাধীন হওয়ার দেড়মাস আগেই রেকর্ড বইয়ে তার নাম উঠিয়ে রাখলেন অরুন নন্দী।

বিশ্বরেকর্ড গড়ার এই অসামান্য কীর্তির জন্য এক লক্ষ রুপী পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল অরুনকে। পুরোটাই তিনি দান করেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাংলাদেশের তহবিলে।

[ ১৯৪১ সালের ২৬ নভেম্বর চাঁদপুরের বাগদী গ্রামে জন্ম অরুন নন্দীর। ২০০৮ সালের ১৬ নভেম্বর কলকাতায় বোনের বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। চিকিৎসার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। ]

এই প্রসঙ্গে দুলাল মাহমুদের অনুলিখনে অরুন নন্দীর নিজের স্মৃতিচারণটা তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না:

…সাঁতার নিয়ে যতই নিমজ্জিত থাকি না কেন, পারিপার্শ্বিকতাকে এড়িয়ে চলা যায় না। জীবন তো আর ঢেউয়ের মতো নির্ভেজাল নয়। ঢেউটাকে প্রতিপক্ষ মনে করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু জীবনের জটিলতার সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। অনেকেই বলেন, খেলাধুলার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। কথাটা বোধকরি সবসময় ঠিক নয়। বনে আগুন লাগলে হরিণের পক্ষে মনের আনন্দে চলাফেরা সম্ভব হয় না। ১৯৭১ সালের মার্চে বারুদপোড়া গন্ধ পেতে থাকি। ২৫ মার্চের কালো রাত যে হয়ে ওঠবে অনন্ত এক দু:স্বপ্নের রাত, আমার পক্ষে তা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। তবে খেলাধুলার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে থাকলেও দেশের রাজনীতির হালচাল যে এক দমই অনুধাবন করতে পারতাম না, তা বলা ঠিক হবে না। রাজনীতির উত্তাল টেউ এসে আমাদেরও দুলিয়ে দিয়ে যেতো। তবে তাতে গা করার চেষ্টা করিনি। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য ও দোসররা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লে আমাদের অবস্থা হয় বনপোড়া হরিণীর মতো।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় থাকতাম চাঁদপুরে। ভেবেছিলাম, যা হবার মিছিল-মিটিংয়ের শহর ঢাকার উপর দিয়েই যাবে। কিন্তু পরিস্থিতি ধারণার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মমতার শিকার হতে থাকেন আশপাশের লোকজন। চলতে থাকে রাজাকার, আল-বদরদের তান্ডব। বেসামাল পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আর সংখ্যালঘু হওয়াটা ছিল সে সময়ের বড় এক পাপ। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু হবার অপরাধে কতো মানুষ যে হয়রানির শিকার হয়েছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। জানতে পারি, সে সময় আমার নামও পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। সঙ্গত কারণে যুদ্ধ শুরু হলে সে তালিকার ভিত্তিতে কিছু একটা ঘটতে পারে বলে সতর্ক হয়ে যাই। মৃত্যুর তালিকা ক্রমশ বাড়তে থাকলে চাঁদপুরে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। জীবন বাঁচাতে মাতৃভূমি ত্যাগ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বাধ্য হয়ে ৮ এপ্রিল সঙ্গী-সাথীসহ চাঁদপুর থেকে আগরতলার উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করি।

এ পথচলাটা ছিল ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা। পথের বাঁকে বাঁকে মৃত্যুর শীতল হাতছানি। দিনের বেলা পরিচিতদের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়েছি। ধাক্কা খেয়েছি। পড়ে গেছি। আহত হয়েছি। কান্তি-শ্রান্তিতে ভেঙে পড়েছি। তবুও পথ চলার বিরাম দেইনি। সে সময় ১৯৫৯ সালে বিকাশ রায় পরিচালিত ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিটির কথা মনে পড়ে যায়। ছবিটিতে অভিনয় করেন উত্তম কুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, অনীল চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রাবতী দেবী, পাহাড়ী সান্যাল, বিকাশ রায় প্রমুখ। সে ছবিতে দেখেছিলাম, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে অবস্থিত হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থকেন্দ্র ‘হিংলাজ’। সে তীর্থে বালুচ মরুভূমি পেরিয়ে যাওয়া কষ্টকর এক সংগ্রাম। সূর্যের গনগনে রোদ। উত্তপ্ত বালু। এক ফোঁটা পানি নেই। নিজের কাছে ‘যক্ষের ধনের’ মতো আগলে রাখা পানি মৃত্যু পথযাত্রী অন্য কাউকে দিতে চান না। পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে পড়তে চায়। পায়ে হেঁটে কিংবা উটের পিঠে চড়ে যেতে যেতে কেউ কেউ ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। তবুও মানুষ ছুটে চলেছেন। সেখানে ছিল সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার পরম আকাক্সক্ষা। আর আমাদের যাত্রা ছিল মানুষ নামক পশুদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার আকুলতা। মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে আমরা পালিয়েছি। তারপরও কেন জানি ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিটির কথাই মনে পড়েছে বার বার। মনে হয়েছে যেভাবে হোক আগরতলা না পৌঁছালে নিভে যাবে জীবনদীপ।

অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় আগরতলা পৌঁছাই। আগরতলায় থাকতেন আমার আপন ছোট বোন। বোন জামাই ফরেস্টে চাকরি করতেন। তাদের বাসায় ওঠি। দীর্ঘদিন পর বোনের সঙ্গে দেখা হয়। ৩/৪ দিন হেসে-খেলে আগরতলায় কাটিয়ে দেই। এরপর রওয়ানা দেই কলকাতা। সে আরেক সংগ্রাম। রাস্তাঘাট ভাঙা। বাসে করে ধর্মপুর যাওয়ার সময় পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি উলট-পালট হওয়ার উপক্রম হয়। ধর্মপুর থেকে ট্রেনে কলকাতা। পাহাড় কেটে ট্রেন লাইন। ট্রেন-যাত্রাটা আগের কষ্টটা ভুলিয়ে দেয়। বাস এবং ট্রেনে গৌহাটি ও আসাম হয়ে কলকাতা যেতে লেগে যায় তিন দিন। আমাকে নেয়ার জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে আসেন মেঝ ভাই মন্টু নন্দী। উঠি বড় ভাই অনিমেষ নন্দীর ১০৪ মদনমোহন ধর্মস্ট্রীটে। মৃত্যুপুরী থেকে পালিয়ে গিয়ে কলকাতায় বেশ কয়েক দিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। তখন তো আমি বল্গা হরিণ। কোনো বাধা নেই। পিছুটান নেই।

ভাইয়ের কথায় দেখতে যাই কলকাতার বিখ্যাত সাঁতারের ক্লাবগুলো। শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত কলেজ স্ট্রিট। উত্তর কলকাতার এ প্রান্তরটি সারাক্ষণই জমজমাট, প্রাণবন্ত ও কোলাহলময়। এ যেন ইন্টালিয়াকচ্যুয়ালদের ঘাঁটি। ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সী কলেজ, স্কটিশ চার্চ কলেজ, বেথুন কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, হেয়ার স্কুল, হিন্দু স্কুল, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি এবং আড্ডার খনি বিখ্যাত কফি হাউস। আর সারি সারি বইয়ের দোকান। দোকান তো নয়, বিশ্ব সাহিত্যের সম্ভার। এর মাঝে চুপটি করে বসে আছে বিদ্যাসাগর সরোবর। ‘কলেজ স্কোয়ার’ নামে যার পরিচয় ও সুখ্যাতি। বিশাল আকারের এ ট্যাংকটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে অসংখ্য সুইমিং ক্লাব ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। রোজ সকাল-বিকাল সব বয়সী ছেলে-মেয়েরা সাঁতার কাটেন। এমন সুইমিং পুল দেখলে জাত সাঁতারুদের পক্ষে অলস প্রহর কাটানো কঠিন। কিছু না ভেবেই ১০ রুপি দিয়ে ভর্তি হয়ে যাই ৫৩/২ কলেজ স্ট্রীট, বউবাজার ব্যায়াম সমিতির সুইমিং ক্লাবে। ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সুইমিং কাবের আছে গৌরবময় ইতিহাস। এ কাবের খ্যাতিমান সাঁতারুদের মধ্যে আছেন প্রফুল্ল মল্লিক, গৌরহরি দাস, আশু দত্ত, জহর আহির, অমল পাল, আব্দুল মুতলিব, দেব প্রসাদ চন্দ্র, দিলীপ পাল, জয়ন্ত মিত্র, আশীষ দাস, সুশীল ঘোষ, গৌর পুরকায়েত, নিতাই পুরকায়েত, কানাই রায় প্রমুখ। সাঁতারের চমৎকার পরিবেশ পেয়ে চুটিয়ে প্রাকটিস করতে থাকি। আমি দু’বেলাই প্রাকটিস করতাম। আর কোচিং দিতেন কেপি সরকার ও তার সহকারী দেবী দত্ত। ওয়াটার পোলোতে আব্দুল মুতালিব। তিনি ছিলেন ১৯৭০ সালে এশিয়ান গেমসে ওয়াটার পোলোতে রানার্সআপ ভারতীয় দলের সাঁতারু। তারা ছিলেন সাঁতারের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাদের কাছে প্রশিক্ষণ পেয়ে আমি দারুণভাবে উপকৃত হই।

পূর্ব পাকিস্তানে সাঁতারের আধুনিক কলাকৌশল সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা ছিল না। ছিল না কোনো কোচ। তাই কলকাতায় আমি সাঁতারের অনেক কিছু শিখতে পারি। চার মাস টানা প্রশিক্ষণ নিয়ে বউবাজার ব্যায়াম সমিতির বাৎসরিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। তাতে আমি চারটি ইভেন্টে প্রথম ও চারটি ইভেন্টে দ্বিতীয় হই। বড়দের গ্রুপে ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল, ১০০ মিটার বাটারফাই, ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক ও ২০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে প্রথম হলে সবাই চমকে যায়। ওয়াটার পোলোতে বউবাজার ব্যায়াম সমিতির পক্ষ থেকে দু’টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। ওয়াটার পোলো ভারতে বেশ জনপ্রিয়। আমার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন বড় ভাই অনিমেষ নন্দী। সাঁতারে এ সাফল্য আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। একদিন পত্রিকায় দেখলাম, বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি গঠন করা হয়েছে। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবলারদের নিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ফুটবল ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে আমিও উৎসাহিত হয়ে উঠি। কিছু একটা করার জন্য আমার মনেও আকুলি-বিকুলি করতে থাকে।

কথা প্রসঙ্গে কে যেন একদিন আমাকে বললেন, ভারতের শৈলেন্দ্র মেমোরিয়াল কাবের সাঁতারু দিলীপ দে কলেজ স্কোয়ারে ৭৯ ঘন্টা সাঁতার দিয়ে গড়েছেন এশিয়ান রেকর্ড। তার এ সাঁতার দেখার জন্য অনেক দর্শক সমাগম হয়। তার এ কৃতিত্বের কথা তখন সবার মুখে মুখে। তাছাড়া কোন একটা বইয়ে দেখেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু বি সি মুল ৮৯ ঘন্টা ৩৫ মিনিট সাঁতার কেটে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন। আমার মনে এমন কিছু করার চিন্তা উঁকি দিয়ে যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই। আর এ স্বাধীনতার জন্য আমাকে কিছু একটা করতে হবে। বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় সাফল্য পাওয়ায় তখন আমি পরিচিত ছিলাম ‘জয়বাংলা’র সাঁতারু হিসেবে। মুজিবনগর দফতরে দেখা হয় সাঁতারু ব্রজেন দাস, মুজিবনগর সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা খন্দকার আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। তাদের বললাম, ‘আমি অবিরাম সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড গড়তে চাই।’ বউবাজার ব্যায়াম সমিতির হয়ে সাফল্য অর্জন করায় তারা খুব খুশি হন এবং আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, তুই তো দেশের জন্য কিছু করেছিস। আরো বড় কিছু যখন করতে চাচ্ছিস, তাতে আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে। তাদের কাছে আশ্বাস পেয়ে আমি এ বিষয়ে চাঁদপুর সম্মিলনীর উপদেষ্টা চাঁদপুরের সন্তান মেঘনা বিড়ির স্বত্বাধিকারী গণেশ সাহা, অনিমেষ রায় চৌধুরী ও সম্পাদক হিমাংসু চক্রবর্তীসহ অন্যান্য কর্মকর্তার সাথে দেখা করলাম। তারা এ সাঁতারের জন্য কিছু খরচ বহন করতে রাজি হলেন।

এরপর বউবাজার ব্যায়াম সমিতি সুইমিং কাবের সম্পাদক নন্দলাল দত্ত, কাচি বাবু, কেপি সরকার ও দেবী দত্তের সাথে এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। তারা সাঁতার আয়োজনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন। চাঁদপুর সম্মিলনী আমার ব্যয়ভার বহনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয়, অরুণ নন্দী অবিরাম সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড গড়বে। এ কথা কলকাতার পত্রিকায় প্রকাশিত হলে দারুণভাবে সাড়া পড়ে যায়। কলকাতার পত্রিকাগুলো বিষয়টি পুরোপুরিভাবে লুফে নিয়ে প্রতিদিনই নিউজ কভারেজ দিতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ এবং বাংলার মানুষের দুঃসময়ে আনন্দ দেয়ার জন্য এ সাঁতার। সাঁতার উদ্বোধনের জন্য বাংলাদেশের মন্ত্রী ও নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, এখন বিশ্বের কাছে আলোচিত ব্যক্তিত্ব হলেন রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। তাকে দিয়ে এই সাঁতারের উদ্বোধন করানো হলে সবাই লুফে নেবে। তবে তারা সবাই অভিমত ব্যক্ত করেন অরুণ নন্দী বিশ্ব রেকর্ড করুক কিংবা না করুক, তার এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে তা স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের জন্য বিরাট ব্যাপার।

পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক কভারেজের পাশাপাশি পুরো কলকাতা শহরজুড়ে আয়োজকদের তরফ থেকে পোস্টারিং করা হয়। ছড়ানো হয় হ্যান্ডবিল। বেতারেও ঘোষণা দেয়া হয়। আসলে প্রচার-প্রচারণার কোনো কমতি রাখা হয়নি। বিষয়টি আলোচিত হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ, কিছুদিন আগে অবিরাম সাঁতারের একটি এশীয় রেকর্ড প্রত্যক্ষ করেছে কলকাতাবাসী। তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তখন একটি তোলপাড় করা ঘটনা। তার সপক্ষে কোনো কিছু করতে এগিয়ে এলে তাকে সমর্থন ও সহযোগিতা করার ব্যাপারে মুখিয়ে থাকে কলকাতার মানুষ। যে কারণে আমি বিশ্ব রেকর্ড গড়ার আগেই সবার কাছে রীতিমত হিরো হয়ে যাই। আমাকে নিয়ে সবার আগ্রহ ও কৌতূহল বেড়ে যায়। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাঁতারের তারিখ ও সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর সকাল আটটায় সাঁতার শুরু করা হবে। উদ্বোধন করবেন কলকাতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। তিনি তখন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানালে তা সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। হোসেন আলী তখন রীতিমত কিংবদন্তি। তার উপস্থিতির আলাদা একটা মহিমা। হোসেন আলী ছাড়াও উপস্থিত হন আওয়ামী লীগ নেতা ফণীভূষণ মজুমদার, ইংলিশ চ্যানেল জয়ী ব্রজেন দাস, চাঁদপুর কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন (অব:) করিমউদ্দীন এবং মুজিবনগর সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

কলকাতায় আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিরাও উপস্থিত হন। ছুটে আসেন সর্বস্তরের বিপুলসংখ্যক মানুষ। কলেজ স্কোয়ার চত্বরে চুল পরিমাণ ঠাঁই ছিল না। সাঁতার শুরুর আগে অতিথিরা বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, অরুন নন্দী রেকর্ড গড়তে নামবেন, রেকর্ড গড়তে পারবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বড় একটি বিজ্ঞাপন। আমি বউবাজার ব্যায়াম সমিতির ভেতরে বিশ্রাম নিয়ে সাঁতার শুরুর প্রস্তুতি নেই। পরনে সুইমিং কস্টিউম। আমিও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখি। আমার বক্তব্যের মূল কথা ছিল- আমাদের মাতৃভূমি আজ শত্রুকবলিত। প্রতিদিনই আমাদের কারো না কারো জীবন ঝরছে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমরা জানি না, আমরা কবে স্বাধীনতা পাব? তবে স্বাধীনতার জন্য আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। আমিও আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা থেকে এই সাঁতার করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ উদ্যোগ কতটুকু সার্থকতা অর্জন করবে, সেটাও জানি না। বাংলাদেশ যদি কখনো স্বাধীন না হয়, তাহলে আমার এই ভূমিকার জন্য মাতৃভূমিতে আদৌ আর ফিরতে পারবো কিনা- সেটা ঝুলে আছে বড় এক প্রশ্ন হয়ে। সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার জন্য আমি সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আপনারা যে উদ্দীপনা নিয়ে আমাকে উৎসাহিত করতে এসেছেন, তা আমাকে দারুণভাবে আন্দোলিত করেছে। এরপর আমাকে মাল্যভূষিত করা হয়। সাঁতার শুরু করতে করতে সকাল সাড়ে আটটা বেজে যায়। বেজে ওঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বুকটা মুচড়ে-মুচড়ে উঠতে থাকে। বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা কান্না অশ্রু হয়ে চোখের কোণে চিক চিক করতে থাকে। সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে একটা দেশাত্মবোধ। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মা-মাটি-মাতৃভূমি।

একবুক প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয় আমার সাঁতার। ব্যর্থ হলে ব্যক্তি আমার কিইবা আসে যাবে। কিন্তু আমার উপর নির্ভর করছে স্বাধীনতাকামী আমার দেশের সম্মান। সেই সম্মানটুকু আমাকে যে করে হোক রক্ষা করতে হবে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই নিবেদনটুকু রাখি। জলে নামতেই একের পর ক্যামেরার কিক। লাইফ সেভার হিসেবে শুরুতে আমার সঙ্গে ছিলেন অবিরাম সাঁতারে এশীয় রেকর্ডধারী দিলীপ দে, নারায়ণ কুন্ডু। এছাড়া বউবাজার ব্যায়াম সমিতির জাতীয় পর্যায়ের ২৫/৩০ জন সাঁতারুকে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়।

অবিরাম সাঁতার আমার কাছে নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে সর্বোচ্চ একটানা সাঁতার কেটেছি ৫৮ ঘন্টা। ১৯৬৮ সালে কুমিল্লার রাণীর দিঘীতে সেই সাঁতার কাটার সঙ্গে পার্থক্য হলো- এবার পরদেশে অনেক মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে গড়তে হবে বিশ্ব রেকর্ড। এভাবে কোনো একটি টার্গেট করে গন্তব্য পৌঁছানো খুবই কঠিন। আর কঠিনেরে ভালোবেসে আমি পাড়ি দিতে থাকি দুরূহ পথ। মাইকে বাজতে থাকে উদ্দীপনামূলক গান। সকাল, দুপুর পেরিয়ে আসে রাত। রাতের বেলা শরীরটা যেন আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। অনুভব করতে থাকি অস্বস্তি। ক্রমাগত বমি হতে থাকে। ১৪ বার বমি হয়। একইসঙ্গে রক্ত যেতে থাকে। আমি ঘাবড়ে যাই। এমনটি আগে কখনো হয়নি। আসলে অতিরিক্ত চাপ ও টেনশন আমাকে কাবু করে ফেলে। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে থাকি, আমাকে শক্তি দাও, সাহস দাও। দাও বল ও ভরসা। আমাকে ও আমার দেশকে এভাবে হেরে যেতে দিতে পারি না। রাতটাও পাড়ি দিতে সক্ষম হই। ৯ অক্টোবর বমিটা কমে যায়। আসে ১০ অক্টোবর। আমার পায়ে ক্রাম ধরে। মনে হচ্ছিল আমি ক্রমান্বয়ে তলিয়ে যাচ্ছি। আমি আর পারছিলাম না। অপরিসীম জেদ আমাকে ভাসিয়ে রাখে। ক্রাম নিয়ে আমি মারাত্মক সমস্যায় পড়ে যাই। ডাঃ শ্যামা দাস ও কোচ দেবী দত্ত আমাকে অনবরত সান্ত¡না দিতে থাকেন, ‘অরুন আরেকটু ধৈর্য ধর, অল্পক্ষণের মধ্যে তোমার ক্রাম সেরে যাবে।’

আমি ব্যথা সইতে পারছিলাম না। তারপরও দৃঢ় মনোবল নিয়ে সাঁতরাতে থাকি। তিন দিন পেরিয়ে আসি। এর আগে এতক্ষণ সাঁতার কাটিনি। আর কতক্ষণ পারবো বুঝতে পারছিলাম না। ১১ অক্টোবর ক্রাম কমে। কিন্তু একটার পর একটা সমস্যায় আক্রান্ত হতে থাকি। আমার বুকে ভীষণ জ্বালা-পোড়া করতে থাকে। হাত দুটো জানিয়ে দেয় তাদের অপারগতার কথা। কান্তিতে ভেঙ্গে পড়া হাত দুটো আর আমাকে ভাসিয়ে রাখতে পারছিল না। ভীষণ যন্ত্রণা। আমার পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া ঘুমে চোখ দুটো মুদে আসছিল। এতটা সময় না ঘুমিয়ে থাকার কী যে যন্ত্রণা, তা অনুভব করতে থাকি পলে পলে। আমার শরীর আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কাউকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। কষ্ট, যন্ত্রণা ও ব্যথা-বেদনায় চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। অথচ প্রাণ খুলেও কাঁদা যাচ্ছিল না। আমার অসহায়তা ও অক্ষমতা আঁচ করতে পেরে লাইফ সেভার পরেশ দত্ত, আমার ভাই অনিমেষ নন্দী আমাকে উৎসাহিত করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর পর চা, দুধ, পানি দিয়ে আমাকে আপ্যায়িত করেন। চারদিকে বাজতে থাকে ব্যান্ড। এটা আমার জন্য টনিক হিসেবে কাজ করে। এতে বেড়ে যায় আমার মানসিক শক্তি। আমি নিজেকে বললাম. আমাকে হারলে চলবে না। আমাকে যে করেই হোক পারতে হবে। আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অবলীলায় বিলিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের জীবন। অসীম সাহসী সেই বীরেরা কত প্রতিকূলতাকে উজিয়ে মাতৃভূমির জন্য লড়াই করছেন। তারা যদি নিজেদের উৎসর্গ করতে পারে, আর আমি এই তুচ্ছ বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে পারবো না, এটা কি করে হয়? যাবতীয় কান্তি, অবসাদকে উপেক্ষা করে আমি নতুন উদ্যমে সাঁতরাতে শুরু করি। অজেয়কে জয় করার একটা জেদ আমার শারীরিক জড়তাকে গুরুত্বহীন করে দেয়। একটুখানি ফলের রস খেয়ে শরীরের ঝিমিয়ে পড়া অঙ্গগুলোকে চাঙ্গা করতে সক্ষম হই। ভারতের খ্যাতিমান সাঁতারু দীলিপ দে’র একটানা ৭৯ ঘন্টা অবিরাম সাঁতারের এশীয় রেকর্ড ভেঙ্গে দেয়ার পর চারদিকে উৎসবের ধুম লেগে যায়। মরা গাঙ্গে যেন নতুন জোয়ার আসে। নতুন উদ্যমে সাঁতরাতে থাকি। তারপরও বিশ্ব রেকর্ডকে মনে হতে থাকে অনেক দূরের পথ।

এক একটা মুহূর্ত যেন আমার কাছে অনন্তকাল। আমার বয়স তখন ২৮ বছর হলেও নিজেকে মনে হচ্ছিল কালজয়ী লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র কিউবান সেই বৃদ্ধ জেলে ‘সান্তিয়াগো’র মত। সেই বৃদ্ধ সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে টানা ৮৪ দিন কোনো মাছের দেখা পেতে ব্যর্থ হন। নিজেকে তিনি দুর্ভাগা ভাবতে থাকেন। কিন্তু তাতেও তিনি হতোদ্যম হয়ে পড়েননি। একবিন্দু আশাও ছাড়েননি। ৮৫তম দিনে অনেক ঝুঁকি নিয়ে সাগরের অনেক গভীরে চলে যান মাছ পাওয়ার আশায়। সেদিন তিনি যথার্থই সফল হন। প্রত্যাশার চেয়েও বিশাল আকারের ‘মারলিন’ নামক একটি মাছ তার জালে আটকাতে সমর্থ হন। এত বড় মাছ ধরেও বিপাকে পড়ে যান তিনি। মাছটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা তার একার পক্ষে প্রকৃতঅর্থেই কঠিন হয়ে পড়ে। জলের শক্তিশালী মাছের সঙ্গে তার মত বৃদ্ধ’র শারীরিক শক্তিতে পেরে ওঠা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। মাছকে বাগে আনতে লড়াই করে কেটে যায় দু’দিন দু’রাত। মাছের সঙ্গে লড়াই চালাতে গিয়ে তিনি ক্ষত-বিক্ষত হন। তবুও হাল ছাড়ার পাত্র নন বৃদ্ধ। তৃতীয় দিনে সাহসী সেই বৃদ্ধ মাছটিকে তার হারপুনে গাঁথতে সক্ষম হন। অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার এ লড়াইয়ে জয়ী হয়ে মাছটিকে নিয়ে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন সান্তিয়াগো। বৃদ্ধ তো দুঃসাহস আর অদম্য মনোবলকে সম্বল করে জয়ী হয়ে ফিরে আসেন, কিন্তু আমার কী হবে? আমিও তো ৮৪ ঘন্টা পেরিয়ে এসেছি। আর মাত্র ৫/৬ ঘন্টা। তাহলেই বিশ্ব রেকর্ড আমার বশীভূত হবে। এই সময়টুকু মহাকালকে যেন থমকে দিয়েছে। সময়ের গতি যে এতটা মন্থর হতে পারে, সেদিন তেমনই মনে হয়েছিল আমার কাছে। মানুষ তো কখনো হারে না। বৃদ্ধ সান্তিয়াগো হারেননি। আর আমি কূলে এসে তরী ডুবিয়ে দেব! তা কী করে হয়?

 এত উদ্যোগ, এত আয়োজন, এত প্রত্যাশা- সব কি ভেস্তে যাবে? বুক ঠেলে কান্না আসছিল। আমি কেন সবাইকে প্রত্যাশার রঙে রাঙিয়ে দিলাম? আমি ব্যর্থ হলে কত মানুষের মন ভেঙ্গে যাবে, অর্বাচীনের মত কেন এমন করলাম? ব্যর্থতার গ্লানি এসে আমাকে যেন কলেজ স্কোয়ারের ট্যাংকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি যেন তলিয়ে যেতে যেতে আবার ভেসে উঠতে থাকি। আমার কানে কানে ফিসফিসানির মত করে কে যেন বলে যায়, ‘আরে তুই তো জলের মানুষ। তোর জীবন কেটেছে জলে জলে। কত টালমাটাল অবস্থায় এই জলের সঙ্গে লড়াই করে তুই জয়ী হয়েছিস। আর আজ জীবনের একটি বড় অর্জনের কাছাকাছি এসে তুই হেরে যাবি।’ অলৌকিক এক দৈববাণী এসে আমাকে আবার জাগিয়ে দিয়ে যায়। আসলে সেটা কি ছিল কোনো অলৌকিকতা, নাকি নিজের মনের কল্পনা- তা আজ অব্দি বুঝতে পারিনি। আমি আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠি। মনে মনে আওড়াতে থাকি, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’। আমাকে জিততেই হবে। অবিচল এই প্রতিজ্ঞা আমাকে সঞ্জীবিত করে। আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য জলে নামেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সাঁতারু ব্রজেন দাস। সে সময় তাকে নাকি আমি অকারণে বেশ বকাঝকা করেছি। ব্রজেন দা পরে আমাকে হেসে হেসে এটা বলেছেন। আসলে আমি তো তখন আর আমার মধ্যে ছিলাম না। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু মনের ইচ্ছেয় সাঁতার কাটতে থাকি। ১২ অক্টোবরের রাত ১২টা পেরিয়ে যায়। গভীর রাত হলেও আলোর কোনো কমতি নেই। এই আলো আমাকে একটু একটু করে নিয়ে যেতে থাকে গন্তব্যের দিকে। চারপাশের হৈ-হল্লা আর উল্লাসের মধ্য দিয়ে আমি বিশ্ব রেকর্ড গড়ি। জয়ী হই দুঃসাহসিক এক চ্যালেঞ্জে। তারপরও অব্যাহত রাখি সাঁতার। আমার শরীর আমাকে সমর্থন না দিলেও মনের জোরে যন্ত্রের মত সাঁতার কাটি।

৯০ ঘন্টা ৫ মিনিট সাঁতার কাটার পর আমার শুভাকাঙ্খীরা আমাকে জল থেকে তুলে নেন। তখন রাত ২টা ৩৫ মিনিট। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের টেউ একটু একটু করে আমাকে দুলিয়ে দিতে থাকে। আমি পুরোপুরি আত্মস্থ না করতে পারলে আমার বোধের মধ্যে প্রবাহিত থাকে তার তরঙ্গ। আমাকে বউবাজার ব্যায়াম সমিতির বিছানায় শুইয়ে দিলে আমি কোথায় যেন হারিয়ে যাই। গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে যাই। কোনো কিছু আর আমাকে স্পর্শ করতে পারে না।

কতক্ষণ যে অচেতন হয়ে ছিলাম, বলতে পারবো না। আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে যখন চোখ মেলি, কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হতে থাকে। আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন একজন সুন্দরী মহিলা। আমার দিকে হাসি হাসি মুখে চেয়ে আছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এ কি মায়া, বিভ্রম নাকি মরীচিকা! সব কেমন জানি তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকে। একটা বিভ্রাটের মধ্যে পড়ে যাই। আস্তে-ধীরে ধাতস্থ হয়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করার চেষ্টা করি। মহিলা আমার দিকে ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে বলেন, কেমন আছ অরুন দা? আমাকে চিনতে পেরেছ? তুমি তো বিশ্ব জয় করেছ। সবাই তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমিও তোমাকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে এসেছি। একটু একটু করে ফিরে আসতে থাকে আমার স্মৃতি। মহিলাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। চিনতে গিয়েও চিনতে পারছি না। ভাল করে তাকাতেই হৃদয়ের গভীরে চিরস্থায়ীভাবে ছাপ ফেলা তার টোল খাওয়া মুখাবয়বের মোহময়ী হাসিটা দেখে আমার বুঝতে বাকি থাকে না। এ তো আমার চিরকাঙ্খিতা সুচিত্রা সেন! আমার বুকের মধ্যে বয়ে যেতে থাকে খুশীর হিল্লোল। এই সেই মানসকন্যা। আমার প্রথম জীবনের প্রথম ভালোবাসা। যার কাছে নিজেকে নিবেদন করে উপেক্ষিত হয়েছিলাম। প্রতীজ্ঞা করেছিলাম, একদিন এই উপেক্ষার জবাব আমাকে দিতে হবে। প্রায় এক যুগের ব্যবধানে আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তে তাকে পেলাম। সেই না পাওয়াটা যেন আজ পূর্ণতা পেল। আমরা একান্তে কিছু সময় কথা বলি। আমি আমার জীবনটাকে শূন্য রেখে দিলেও বাণী দত্তের জীবনে যোগ হয়েছে স্বামী ও এক পুত্র। তার স্বামী ও পুত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়। জানতে পারলাম, ছেলের নাম অরুণ। এটা শোনার পর জীবনে এতটা অবাক আর কখনো হইনি। এ নিয়ে আমার মনে অনেক প্রশ্ন ভিড় করলেও তার উত্তর জানার অবকাশ হয়নি। আমাকে তারা তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। একটা আলোড়ন সৃষ্টি করা ঘটনা ঘটানোর পরও বাণী দত্ত যেন আমাকে একটা নস্টালজিয়ার মধ্যে সম্মোহিত করে রেখে যান। তার মৌতাত আমার হৃদয়ে সুখের অনুরণন তোলে। অবশ্য একটু পরই কাটিয়ে উঠি এই হ্যাঙ-ওভার। কেননা, ওঁরা চলে যেতেই আমাকে নিয়ে বয়ে যেতে থাকে উন্মাদনা।

ভোরের আলো ফোটার আগেই চারদিকেই চাউর হয়ে যায় আমার কীর্তির কথা। আমাকে দেখার জন্য বন্যার স্রোতের মত মানুষ আসতে থাকেন। সেদিন আমি পেয়েছিলাম মানুষের বুকভরা ভালোবাসা। অনেকেই আমার জন্য অনেক উপহার নিয়ে আসেন। সেসব বড় তুচ্ছ মনে হয়েছে, মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে গিয়ে। আমাকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে আসেন মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী কামরুজ্জামান, আবদুল মান্নান, ফণীভূষণ মজুমদার, শেখ আবদুল আজিজ, হোসেন আলীসহ নীতি-নির্ধারকদের প্রায় অনেকেই। আসেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, বরেণ্য লেখক অন্নদা শংকর রায়, প্রবোধ কুমার সান্যাল, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব শৈলেন মান্না থেকে শুরু করে কে নন? ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ভারতের ডঃ বিমল চন্দ্র, আরতী সাহাও উপস্থিত ছিলেন। আমার কীর্তিকে তারা নিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও সহমর্মিতা হিসেবে। আর কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশের কে আসেননি? শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিবিদ, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিকদের যেন ঢল নেমেছিল। সবার উপস্থিতির কথা আমি বলতে পারবো না। তাদের কারো কারো সঙ্গে দেখা হলেও অধিকাংশের উপস্থিতির কথা আমি শুনেছি। তবে আমার এই কীর্তির পর যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাদের অনেকেই আমাকে জানিয়েছেন, তারা আমার সাঁতার দেখেছেন।
তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তাতে আমার এই কীর্তির কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। খ্যাতিমান সাহিত্যিক শওকত ওসমান ‘স্মৃতিকথা- : মুজিবনগর’ গ্রন্থে ডায়রির মত করে লিখেছেন, ‘৯ অক্টোবর ’৭১, চাঁদপুরের ছেলে অরুণ কুমার নন্দী গতকাল থেকে কলকাতার কলেজ স্কোয়ার ট্যাঙ্কে সাঁতার কাটছে বিশ্ব রেকর্ড করার প্রত্যাশায়। বেশ ভিড় জমে যায় চারদিকের পাড়ে। অনেকে ওকে উৎসাহ যোগাচ্ছে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে। দেখা যাক কী হয়। অবিশ্যি অরুণ নন্দী পূর্বেও সাঁতারু হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশে।’ ১২ অক্টোবর ’৭১-এ তিনি লেখেন, ‘জয় বাংলা! জয় বাংলা! সাঁতারু অরুণ কুমার নন্দী এক বিশ্ব রেকর্ড করে বসে আছে। কাছে গিয়ে এই বীরকে অভিনন্দন জানাতে হয়। তার কৃতিত্ব স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অমূল্য অবদান। একটানা লাগাতার সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড ছিল ৮৯ ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট। অরুণ নন্দী ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাঁতারে সেই রেকর্ড চুরমার করে দিয়েছে। আর এক ব্রজেন দাসকে পাওয়া গেল। বাংলাদেশের অধিবাসীর এই তাক-লাগানো ম্যাজিক বিশ্ববাসীকে দুর্দিনে আরো আমাদের কাছে টেনে আনবে। জয় বাংলা! জয় বাংলা! বিখ্যাত সাঁতারু। ইংলিশ-চ্যানেল পারাপারে বিজয়ী।’ এখনও যখন অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তারা আমার বিশ্ব রেকর্ডের কথা স্মরণ করেন। তাদের কেউ কেউ তখন হয়ত বিখ্যাত ছিলেন না, পরবর্তীকালে তারা সাফল্য পেয়েছেন, পেয়েছেন খ্যাতিও। আমার প্রতি তাদের আগ্রহ ও কৌতূহল দেখে অনুধাবন করা যায়, কত লোক যে এই সাঁতারের প্রত্যক্ষদর্র্শী হয়েছিলেন। ভারত ও বাংলাদেশের বেতার ও সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার নেয়ার হিড়িক পড়ে যায়। আকাশবাণী বেতারের জন্য আমার সাক্ষাৎকার নেন বিখ্যাত বেতারশিল্পী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছবিসহ আমার নিউজ কভারেজ দেয়া হয়। অবশ্য এ বিষয়টি এখন পর্যন্ত কভারেজ পেয়ে আসছে। এ নিয়ে লেখালেখি কখনও থেমে থাকেনি। প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন-বার্তা পাঠান মুজিবনগর সরকারের অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান, হাইকমিশনার হোসেন আলী।
এরপর আমাকে সংবর্ধনা দেয়ার হিড়িক পড়ে যায়। প্রথম সংবর্ধনা প্রদান করে আমার সাঁতারের আয়োজক ত্রিপুরা সমিতি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট হলে আয়োজিত এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ত্রিপুরা সমিতির সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত অনিমেষ রায় চৌধুরী। এ সময় হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার সম্পাদক শুধাংসু বাবু, দৈনিক বসুমতি পত্রিকার বার্তা সম্পাদক দক্ষিণারঞ্জন বোস প্রমুখ বক্তৃতা দেন। বিপুলসংখ্যক লোক এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমাকে ‘সন্তরণশ্রী’ খেতাব দেয়া হয়। এছাড়া সংবর্ধনা প্রদান করে বউবাজার ব্যায়াম সমিতি, হাওড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থা, গোলাবাড়ী সুইমিং কাব, হাতিরপুল সমিতি, বেহালা যুব সংঘ, রবীন্দ্র সদন, কলেজ স্ট্রীট দোকানদার সমিতি, যাদবপুর সংস্থা প্রভৃতি। প্রায় ৩০টির মত প্রতিষ্ঠান সংবর্ধনা দেয়। তাতে আমাকে অনেক কম্বলসহ নানা উপহার দেয়া হয়। আমি তা বাংলাদেশের দুস্থ লোকদের মধ্যে দেয়ার জন্য বিলিয়ে দিয়েছি। সংবর্ধনা সভাগুলোতে আমাকেও বক্তৃতা দিতে হয়। আমি তো বক্তৃতা দিতে পারদর্শী নই। তবে মনের আবেগটুকু প্রকাশ করতে অসুবিধা হয়নি। আমি বলেছি, পরাধীন মাতৃভূমির মুক্তির জন্য আমি সাঁতারে এই বিশ্ব রেকর্ড গড়েছি। এই রেকর্ড যদি বিন্দুমাত্র কাউকে অনুপ্রাণিত কিংবা কোনো অবদান রাখতে পারে, তাহলে আমার এই কষ্ট ও পরিশ্রম সার্থক হবে। তবে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আমি সবাইকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানাই। বলি, আপনারা বাঙালি, আমরাও বাঙালি। আজ পদ্মা-মেঘনা নদী বাঙালিদের রক্তে লাল। আপনারা এগিয়ে না এলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। বক্তৃতা দিতে দিতে আমি বোধহয় আপ্লুত হয়ে উঠি। আমার কথা শুনে সবাই দেখতাম চুপ করে থাকতেন। আমি তাদের বুকের মধ্যে কিছুটা হলেও ঝাঁকুনি দিতে পেরেছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে কেউ কেউ আমাকে বলেন, আমি রাজনীতি করি কিনা? আমার বক্তৃতা শুনে তাদের কাছে তেমনটি নাকি মনে হয়েছিল।

সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ডের ঘটনায় আমার একটা ব্যাপক পরিচিতি গড়ে ওঠে। সর্বত্র আমি ভক্তি-সম্মান পেতে থাকি। যেখানে যাই, সবাই আমাকে খাতির-যত্ন করতে থাকেন। আগ বাড়িয়ে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেন। কতজন যে আমার অটোগ্রাফ নিয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। আমার একটা পরিচিতি আসার পর তা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকি। বিশেষতঃ যারা বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, অথচ পরিস্থিতির কারণে অর্থনৈতিক সমস্যায় ছিলেন, তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করি। আমার সঙ্গে ছিলেন চাঁদপুরের এমপি অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম। পাকিস্তান রেডিওর খবরে বলা হয়, কলকাতার হাওড়া ব্রীজ নাকি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তা শুনে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম। বুঝতে পারছিলাম, আমাদের সুদিন ঘনিয়ে আসছে। …