জামায়াতে ইসলামী যে কারণে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন…
রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ বড্ড জটিল জিনিস। সাধারণ নাগরিকদের তা বোধে আসে না। মুক্তিযুদ্ধে যে মানুষটি তার স্বজনদের হারিয়েছে, বোনকে ধর্ষিতা হতে দেখেছে, তাকে রাজনৈতিক মলম দিয়ে সব ভুলে যাওয়ার আশ্বাস দেওয়া একরকম ধৃষ্টতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠানে যে স্থবিরতা চলছে তাতে এবার নতুন ফতোয়া যোগ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে আদালত যখন (কাদের মোল্লার রায়ে) উল্লেখ করে দেন, তখন সংগঠনটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের নাগরিক দাবিকে উপেক্ষা করে সম্প্রতি ভিন্ন সুর শোনানো হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের তরফে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে থাকা একজন মাঠকর্মী হিসেবে আমার জন্য তা এক বিশাল হতাশা হয়ে এসেছে। কারণ আমি যেই যুক্তিতে আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখি একই যুক্তিতে জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীনতাবিরোধী একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখি। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে। একইভাবে জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে এদেশে গণহত্যা ধর্ষণ ও লুটপাটে রাজনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি সশস্ত্র সহযোগিতা দিয়েছে।
মুখে বললেই তো হয় না। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই প্রমাণ লাগে। আমার দাবির স্বপক্ষে আমি তুলে ধরছি কিছু প্রমাণাদি। প্রথমেই বলা দরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের ভিন্নতা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যতই ঘোট পাকানোর চেষ্টা করুক। দুটো একই জিনিস। যুদ্ধাপরাধের মধ্যেই রয়েছে হত্যা, ধর্ষন, উচ্ছেদ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এখানে ভিকটিমরা সশস্ত্র বা সামরিক বাহিনীর সদস্য নয়, বেসামরিক লোকজন যারা যুদ্ধের পক্ষ নয় কিন্তু যুদ্ধকালে হিংস্রতার শিকার। একইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যেই রয়েছে ঘাতক ও দালালের সংজ্ঞাও । দালাল তারাই যারা মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সব ধরণের সহায়তা করেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে। ঘাতক তারাই যারা পাকিস্তানীদের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে হত্যা-ধর্ষণ ও লুন্ঠনে মেতেছে। তাই জামায়াত সদস্যদের ঘাতক বলা হয়েছে দালাল বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী বলা হয়নি এটা হচ্ছে মূর্খের দাবি, যা অল্পশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিতদের কনভিন্স করবে। অবশ্য জামায়াত বরাবরই এদেশে শিক্ষায় অনগ্রসর অংশটাকে পুজি করে যা তা বুঝিয়ে ফায়দা লুটেছে। সময় এসেছে সেই মিথ্যাচারের মুখোশ খোলার।
১৯৭৩ সালে যে আইনটি করা হয়েছিলো সেটা পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী ও তাদের এদেশীয় দালাল দুইপক্ষের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছিলো। এর আগে ’৭২ সালের দালাল আইনে যে বিচার চলছিলো তা ছিলো এদেশীয় আইন।এই বিচারকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতেই স্পেশাল ট্রাইবুনাল এক্ট করা হয়। সেই আইনের শুরুতেই স্পষ্ট করে লেখা আছে:
ACT NO XIX OF 1973*
An Act to provide for the detention, prosecution and punishment of persons for genocide, crimes against humanity, war crimes and other crimes under international law
(Published in the Bangladesh Gazette, Extra., on July 20, 1973)
Whereas It is expedient to provide for the detention, prosecution and punishment of persons for genocide, crimes against humanity, war crimes and other crimes under international law and for matters connected therewith;
It is hereby enacted as follows :
1. Short title, extent and commencement.
(1) This Act may be called the International Crimes (Tribunals) Act 1973.
(2) It extends to the whole of Bangladesh.
(3) It shall come into force at once.
2. Definitions.
In this Act, unless there is anything repugnant in the subject or context.-
(a) ‘auxiliary forces’ includes forces placed under the control of the Armed Forces for operational, administrative, static and other purposes;
(b) ‘Government’ means the Government of the People’s Republic of Bangladesh;
(c) ‘Republic’ means the People’s Republic of Bangladesh;
(d) ‘service law’ means the Army Act, 1952 (XXXIX of 1952), the Air Force Act, 1953 (VI of 1953) or the Navy Ordinance, 1961 (XXXV of 1961) and includes the rules and regulations under any of them;
(e) ‘territory of Bangladesh’ means the territory of the Republic as defined in article 2 of the Constitution of the People’s Republic Of Bangladesh;
(f) ‘Tribunal’ means a Tribunal set up under this act.
3.Jurisdiction of Tribunal and crimes.
(1) A tribunal shall have the power to try and punish a person irrespective of his nationality who, being a member of any armed, defence or auxiliary force, commits or has committed in the territory of Bangladesh, whether before or after the commencement of this Act, any of the following crimes.
(2) The following acts or any of them are crimes within the jurisdiction of a Tribunal for which there shall be individual responsibility, namely : –
(a) Crimes against Humanity : namely murder, extermination, enslavement, deportation, imprisonment, abduction, confinement, torture, rape or other inhumane acts committed against any civilian population or prosecution on political, racial, ethnic or religious ground whether or not in violation of the domestic law of the country where perpetrated;
(b) Crimes against Peace : namely planning, preparation, initiation or waging of a war of aggression or a war of violation of international treaties, agreements or assurances;
(c) Genocide : meaning and including any of the following acts committed with intent to destroy in whole or in part, a national ethnic, racial, religious or political group, such as :
(i) killing members of the group;
(ii) causing serious bodily or mental harm to members of the group;
(iii) deliberately inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its physical destruction in Whole or in part;
(iv) imposing measures intended to prevent births within the group;
(v) forcibly transferring children of the group to another group;
(d) War Crimes : namely, violation of laws of customs of war which include but are limited to murder, ill treatment or deportation to slave labour or for any other purpose of civilian population in the territory of Bangladesh; murder, ill treatment of prisoners of war or persons on the seas, killing of hostages and detenues, plunder of public or private property, wanton destruction of cities, towns or villages or devastation justified by military necessity;
(e) violation of any humanitarian rules applicable in armed conflicts laid down in the Geneva Conventions of 1949;
(f) any other crimes under international law;
(g) attempt abetment or conspiracy to commit any such crimes;
h. complicity in or failure to prevent commission of any such crimes.
4. Liability for Crimes.
(1) When any crime specified in section 3 is committed by several persons, each of such person is liable for that crime in the same manner as if it was done by him alone;
(2) Any Commander or superior officer who orders, permits, acquiesces or participates in the commission of any of the crimes specified in section 3 is connected with any plans or activities involving the commission of such crimes or who fails or omits to discharge his duty to maintain discipline or to control or supervise the actions of the persons under his command or his subordinates or any of them commit any such crimes or who fails to take necessary measures to prevent the commission of such crimes is guilty of such crimes.
আইনে স্পষ্ট করেই উল্লেখ হয়েছে সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহযোগী বাহিনীর কথা। এখানে সামরিক বাহিনী মানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তাদের সহযোগী বাহিনী হচ্ছে রাজাকার (আল-শামস ও আল-বদর), মুজাহিদ, ইপিসিএএফ-এর মতো আধা-সামরিক বাহিনীগুলো। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের স্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এই আইনে।
যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে অভিযুক্ত করার জন্য নীচের কারণগুলোই যথেষ্ট:
১.জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের আমির গোলাম আযম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং শীর্ষ নেতাদের একজন ছিলো। শান্তি কমিটির নেতৃত্বে সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ভার তার এবং তার সংগঠনের ওপর বর্তায়।
২. জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যাবতীয় তৎপরতাকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছিলো। এসব তৎপরতায় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং বাস্তভিটা থেকে উচ্ছেদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ অন্তর্ভূক্ত। এসব অপরাধের সমান দায় তাদেরকে নিতেই হবে।
৩. জামায়াতে ইসলামী রাজাকার বাহিনী এবং এর অধীনস্থ বিশেষ ঘাতক সংস্থা আল-বদর গঠন করে। এসব বাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত। এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে রাজাকার বাহিনীকে (আল-শামস ও আল-বদর নামে বিভক্ত) ব্যবহার করে জামাতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নির্মূল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ চালাচ্ছে এমন অভিযোগ তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোই সেসময় করেছিলো। জামায়াত এসব সমালোচনাকে ইসলাম ও পাকিস্তান বিরোধী বলে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে নিজেদের কর্মকান্ডকে নায্য বলে দাবি করে।
৪. আল-বদর বাহিনী সুনির্দিষ্টভাবে গঠিত হয়েছিলো জামায়াতের ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তানী ইসলামী জামায়াতে তালাবা বা ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির)সদস্যদের নিয়ে। বিজয়ের আগে বুদ্ধিজীবি হত্যার জন্য এই আল-বদর সদস্যরা অভিযুক্ত।
দেখা যাক এই অভিযোগগুলোর স্বপক্ষে কি কি প্রমাণ আছে আমাদের হাতে।
১. প্রসঙ্গ নৃশংসতায় জামায়াতের দলীয় দায়:
জামাতে ইসলামী দলীয়ভাবে কি ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তার প্রমাণ হিসেবে তুলে দেওয়া যেতে পারে একটি ভিডিও ফাইল। ব্রিটেনভিত্তিক চ্যানেল ফোর প্রযোজিত ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ নামের তথ্যচিত্রটি থেকে নেওয়া এই ফুটেজে সিলেটে জামাতের একটি জনসভার কর্মকান্ড এবং তারপর সংঘটিত একটি হত্যাকান্ডের বর্ণনা শোনা যাক প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে। প্রসঙ্গত এ হত্যাকাণ্ড জামাত রাজাকার বা আলবদরের সামরিক লেবাসে ঘটায়নি:
২. প্রসঙ্গ শান্তি কমিটির নেতৃত্বের দায়:
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল নুরুল আমিনের নেতৃত্বে খাজা খয়েরউদ্দিন এবং গোলাম আযমসহ ১২ জন রাজনৈতিক নেতা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে এবং সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার আশ্বাস দেয় এবং এ জন্য ‘সর্বদলীয় নাগরিক কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব দেয়। এ বিষয়ে ৫ এপ্রিল প্রকাশিত পূর্বদেশ পত্রিকায় লেখা হয় প্রতিনিধিদল টিক্কা খানকে ‘অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসনকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস এবং জনগণের মন থেকে ভিত্তিহীন ভয় দূর করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়।’ টিক্কা খান তাদের ‘শুধু বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের অখন্ডতা রক্ষায় ফলপ্রসু কাজ করতে নির্দেশ দেন।’ …‘বৈঠক শেষে নেতৃবৃন্দ রেডিওতে ভাষণ দিয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তার প্রতিজ্ঞা করেন’ সে প্রতিজ্ঞা পালন করেছিল গোলাম আযম ।
টিক্কা খান চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের এসব মৌলবাদী দল একই প্লাটফর্মে থেকে সামরিক বাহিনীকে সার্বিক সহযোগিতা করবে। সেটা ধাক্কা খায় শান্তি কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে জামাতের সঙ্গে নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগের তিনটি অংশ (কাউন্সিল, কাইয়ুম ও কনভেনশন) এবং পিডিপির সংঘাতে। বিশেষ করে মৌলভী ফরিদ আহমদ (নেজামে ইসলামী প্রধান) ও নুরুজ্জামান (পাকিস্তান পিপলস পার্টির পূর্ব পাকিস্তান প্রধান) জামায়াতের নেতৃত্বে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ কারণে ৬ এপ্রিল পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক হামিদুল হক চৌধুরীকে নিয়ে টিক্কা খানের সঙ্গে আবারও দেখা করে গোলাম আযম এবং আগের প্রস্তাবনাটি আরেকটু ঘষামাজা করে ‘নাগরিক শান্তি কমিটি’ গঠনের অনুমোদন চায়। মূলত হামিদুল হক চৌধুরীর মধ্যস্থতাতেই জামায়াতের সঙ্গে অন্য দলগুলোর মতপার্থক্য ভুলে রাজনৈতিক সমঝোতা হয় সর্বদলীয় শান্তি কমিটি গঠনে।
৯ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে শপথ নেয় টিক্কা খান। একই দিন খাজা খয়েরউদ্দিনকে আহবায়ক করে ১৪০ জন সদস্য নিয়ে ঢাকায় নাগরিক শান্তিকমিটি আত্মপ্রকাশ করে। এর সংগঠক হিসেবে নাম দেওয়া হয় তিনজনের: অধ্যাপক গোলাম আযম, এ.কিউ.এম শফিকুল ইসলাম এবং মওলানা সৈয়দ মাসুম। তবে পত্রিকায় এই খবর আসে ১১ এপ্রিল। কারণ গঠনের পরপরই এর নেতৃত্বে আবারও কোন্দল দেখা দেয়। ১০ তারিখ মৌলভী ফরিদ আহমদকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে মূল শান্তি কমিটি থেকে বের হয়ে যায় এবং গঠন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও কল্যান কাউন্সিল’।
১৩ এপ্রিল বায়তুল মোকাররমে জোহারের নামাজের পর একটি মিছিল বের করে শান্তি কমিটি। ‘পাক-চীন জিন্দাবাদ, দুষ্কৃতিকারীরা দূর হও, মুসলিম জাহান এক হও, ভারতকে খতম করো’ ইত্যাদি ফেস্টুন নিয়ে মিছিলটি ঢাকার প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে নিউমার্কেটে শেষ হয়। মিছিল শেষে খাজা খয়েরউদ্দিন বক্তৃতা করে এবং মোনাজাত পরিচালনা করে গোলাম আযম। সমাবেশ শেষে মিছিলকারীরা আজিমপুর কলোনী, শান্তিনগর, শাখারি বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বাঙালীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় এবং অনেককে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখে।
১৪ এপ্রিল নাগরিক শান্তিকমিটির বৈঠক বসে। সেখানে নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি’ রাখা হয়। এর ফলে কমিটি সারা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে বলে সভার প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়। প্রস্তাবে আরো বলা হয় প্রয়োজন অনুসারে কমিটি যে কোনো সময় সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারবে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিট গঠন করে ‘মিশনের কাজ’ সাফল্যমন্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভা যে কোন বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কার্যকর করার জন্য ২১ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে যার অন্যতম সদস্য ছিল গোলাম আযম। বর্ষীয়ান খায়েরউদ্দিনকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করলেও জামায়াতে ইসলামীর হাতেই ছিলো এর নেতৃত্ব। যার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় অফিসের ঠিকানা। মগবাজারের ৫ নং এলিফেন্ট লেনের সেই বাড়িটি এখন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৬ এপ্রিল আবার টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করে নিজেদের কার্যক্রম শুরু করার কথা জানায় গোলাম আযমসহ শান্তি কমিটির শীর্ষ নেতৃত্ব।
প্রথমেই এটা জেনে নেওয়া যাক শান্তি কমিটি আসলে কতখানি শক্তিধর ছিলো যে তাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একই যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে! বিস্তারিত আখ্যানে যাওয়ার আগে সে সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটা আমলে আনা যাক। পূর্ব পাকিস্তান তখন সামরিক আইনের আওতায় চলছিলো এবং সামরিক বিধিবলে সব ধরণের মিটিং-মিছিল এবং বেসামরিক লোকজনের সশস্ত্র চলাফেরা নিষিদ্ধ ছিলো। তবে ইসলামী সমাবেশের ক্ষেত্রে এই আইন ছিলো শিথিল, শান্তি কমিটির ক্ষেত্রে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হয়েছিলো আইনটিতে। ১৫ জুন সামরিক অধ্যাদেশ নং-২১ জারি করে এলাকাভিত্তিক ও আঞ্চলিক সব স্থানীয় কমিটিকে বিলুপ্ত করার অধিকার আদায় করে টিক্কা খানের অধীনস্থ প্রশাসন। মহল্লার সর্দার প্রথা, ইউনিয়ন কমিশনার কিংবা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা বিলুপ্ত করে সে জায়গাটা এককভাবে দেওয়া হয় শান্তি কমিটিকে। তারাই সরাসরি সামরিক প্রশাসকের বেসামরিক প্রতিনিধির মর্যাদা পায়। একইভাবে অস্ত্রবহন ও স্থানান্তরের বিধিটিও (সামরিক অধ্যাদেশ নং-১২২) শান্তি কমিটির অধীনে অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং তাদের সেগুলো ব্যবহারের অনুমোদন জায়েজ করা হয়।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন: এখানে
মূলত আওয়ামী লীগ, হিন্দু এবং স্বাধীনতাপন্থীদের তালিকা তৈরি করে সেগুলো সামরিক প্রশাসনকে সরবরাহ করার দায়িত্বে ছিলো শান্তি কমিটি। পরে তারা এই সহযোগিতা সামরিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত করার অধিকার আদায় করে নেয়। গঠন করে বিভিন্ন রকমের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এমন বাহিনীর মধ্যে রাজাকার,মুজাহিদ, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস অন্যতম। শান্তি কমিটির ছায়ায় জামায়াত গঠন করে রাজাকার যার দুটো শাখা ছিলো আল-শামস (সদস্য ও সমমনাদের নিয়ে গঠিত) এবং আল-বদর (ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত)। মুজাহিদ বাহিনীও শান্তিকমিটির আওতাভুক্ত হলেও এতে অন্তভূর্ক্ত ছিলো অন্য দলগুলোর সদস্যরা। যদিও এদের অস্ত্র বন্টন ও সনদ জামায়াতে ইসলামীর প্যাডেও অনেকসময় দেওয়া হয়েছে। এর একটা কারণ হতে পারে মূল প্রতিপক্ষ নেজামে ইসলামীর চেয়ে জামায়াতের সাংগঠনিক বিন্যাস আরো বিস্তৃত ছিলো এবং মুসলিম লীগ তিন খন্ডে বিভক্ত হওয়ায় তারাও বাধ্য হয়ে জামায়াতের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলো।
রাজাকার নির্বাচন, নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ শান্তি কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিলো। এর প্রমাণ হিসেবে ‘৭১এর ২১ জুন শান্তি কমিটির ওয়ার্কিং কমিটির তরফে শাখা কমিটিগুলোর কাছে পাঠানো নির্দেশনাটি তুলে ধরা যেতে পারে (লিঙ্ক)। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা এই দলিলটিতে একদম উপরে ডানে ওয়ার্কিং কমিটির এক নম্বর সদস্য হিসেবে গোলাম আযমের নাম লেখা হয়েছে। নির্দেশনার ‘ই’ পরিচ্ছদে বলা হয়েছে:
সামরিক প্রশাসকের দফতর থেকে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে দেশপ্রেমিকদের নিয়ে রাজাকার এবং গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করার নির্দেশ পাঠানো হয়েছে এবং তাদের রাইফেল এবং প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেওয়া হবে । জেলা এবং বিভাগীয় শান্তি কমিটিগুলোকে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সামরিক আইন প্রশাসকের কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে কারণ শান্তি কমিটির সুপারিশেই সরকার রাজাকারদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় শান্তিকমিটির তত্বাবধানে অবিলম্বে প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপ-কমিটি গঠন করতে হবে এবং তারা শুধু এই বিষয়টাতেই পুরোপুরি এবং সর্বোতভাবে মনযোগ দেবে। একই নির্দেশনায় পরিত্যক্ত বাড়িঘর দখলের নির্দেশনাও রয়েছে।
শান্তি কমিটির দেশজুড়ে স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতায় কতখানি সংশ্লিষ্ট ছিলো তার প্রমাণ হিসেবে আমরা কিছু উপাত্ত তুলে ধরতে পারি:
ক. ঢাকা শহরের একজন রাজাকারের পরিচয়পত্র। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত এ পরিচয়পত্রটিতে শান্তি কমিটির উল্লেখ লালদাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে:
খ. পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে কষ্ট করে ঘরে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করতে হতো না। বরং শান্তি কমিটিই তাদের জন্য নিয়মিত মেয়ে সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিলো। প্রমাণ হিসেবে একটা চিঠি তুলে দেওয়া যেতে পারে। ‘৭১এর ২৮ মে বরিশালের ঝালকাঠি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছলিমুদ্দিন মিয়া এক চিঠি পাঠিয়েছিলেন কীর্তিপাশা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আজহার মিয়াকে। শান্তি কমিটির আঞ্চলিক প্যাডে লেখা চিঠির কথাগুলো এরকম:
ভাই সাহেব
সালামবাদ সমাচার, আপনার কীর্তিশালা কমিটিতে ইউনিট কমান্ডার হিসেবে আঃ রবের নাম শাহ আলম ছার পাশ করিয়া নিয়েছেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে উত্তর দিকের শয়তান দমন করার জন্য যাইতে হইবে। আপনার এলাকার সব ইন্ডিয়ান দালালদের যত তাড়াতাড়ি পারেন ধরিয়া ক্যাম্পে পাঠাবেন। ওদের হেদায়েত করার পর উত্তর দিকের অপারেশন শুরু করা হইবে। এদিকে ইতিপূর্বে পাঠানো অস্ত্র যেন ইন্ডিয়ার দালালরা খুঁজে নিতে না পারে। বেগ সাহেবের জন্য ভালো মাল পাঠাবেন। রোজ অন্তত একটা অন্যদের জন্য মাল পারেন। খোদা আমাদের সহায় আছেন। আল্লাহ হাফেজ।
গ. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত এই চিঠিটি বঙ্গবন্ধুকে লিখেছিলেন এক বীরাঙ্গনার বাবা। ১৩ ডিসেম্বর তার বাড়ি ঘেরাও করে তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পাশাপাশি মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় রাজাকাররা।
ঘ. ৩১ জুলাই নাটোরের মিনার সিনেমা হলের ম্যানেজারকে পাঠানো চিঠি। প্রশিক্ষণরত রাজাকারদের মাইন্ড রিফ্রেশের জন্য নাইটশোতে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শান্তি কমিটির প্যাডে:
ঙ. ভুরুঙ্গমারির এক মুসলিম লীগ নেতার ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন পত্র। শমসের-ই-মূর্তজা নামে ওই লোক দাবি করে মুক্তিবাহিনী তার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং রংপুরে একটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে সেখানে বাড়ি নির্মাণে সহায়তা চেয়ে ১৮ হাজার ৩২০ টাকা দাবি করে। তার আবেদনটি মঞ্জুর করে শান্তি কমিটি :
চ. ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী এবং দুষ্কৃতিকারীদের (দুটোই ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের জামায়াতি সম্বোধন) নিয়মিতই তারা হত্যা করছিলো এবং সেগুলো খবরও হচ্ছিলো। প্রমাণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে ৬ আগস্ট পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের একটি সাফল্যের খবর। কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে ৬ জন ভারতীয় দালালকে (মুক্তিযোদ্ধা) হত্যা এবং দুজনকে বন্দী করার ওই খবরে স্থানীয় শান্তিকমিটির চেয়ারম্যানের (জামায়াত সদস্য) স্ত্রীও অংশ নিয়েছেন বলে লেখা হয়।
৩. প্রসঙ্গ :পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক সমর্থনের দায়
জামাতের রাজনৈতিক সহযোগিতার প্রমাণ হিসেবে আমরা আমলে নিতে পারি ১৯৭১ সালের ১৮ থেকে ২১ আগস্ট লাহোরে অনুষ্ঠিত জামাতের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের সারবেত্তাকে। টানা চারদিনের ওই বৈঠক শেষে জামাতে ইসলামী এর কেন্দ্রীয় নেতাদের সম্মতিক্রমে একটি রাজনৈতিক সংহতিপত্র (পলিটিকাল রেজ্যুলুশন) প্রকাশ করে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যাবতীয় কর্মকান্ডকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তাতে সমর্থন জানানো হয়। একই বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের শান্তি শৃংখলা ফেরাতে সেনাবাহিনীকে আরো কঠোর হওয়ার আহবান জানায় তারা। ২০ আগস্ট পাকিস্তানী বার্তাসংস্থা পিপিআইর বরাত দিয়ে ‘ Jamaat upholds action to crush armed rebellion’ শিরোনামে দ্য মর্নিং নিউজ পত্রিকায় লেখা হয়:
The action taken by the Government of Pakistan to crush the armed rebellion in East Pakistan by the outlawed Awami League in connection with Indian warlords and their agent has been fully upheld by the central council of the Jamaat-i-Islami which went into session for the third consecutive day here today under the presidentship of the Deputy chief of the party Maulana Abdur Rahim.
আগেই বলা হয়েছে সামরিক সমর্থনে বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে আলাদাভাবে নিজেদের চেনাতে উদ্যোগী ছিলো জামাত। এর নমুনা মেলে গোলামের একটি বক্তব্যে। ১৭ আগস্ট ওই বৈঠক উপলক্ষ্যে লাহোরে নামার পর পাকিস্তানি সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেয় সে।পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জোটে জামাতের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে গোলাম স্পষ্ট জানায় : Jamaat had nothing to do with the merger of various political parties. The Jamaat, he said, would keep its entity as it could not accept readymade leadership. (morning news 18th august 1971)
বিস্তারিত: এখানে
দলীয় সংবিধানে এই সমর্থনকে সর্বসম্মতিতে পাশ করানোর আগে থেকেই অবশ্য বক্তৃতা বিবৃতিতে এসব কথা বলে আসছিলো গোলাম আযম। প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে ২০ জুন লাহোরে জামাত কার্যালয়ে তার বক্তৃতার অংশবিশেষ। ২১ জুন বার্তাসংস্থা এপিপির বরাতে ‘সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার বিকল্প ছিলো না’ শিরোনামে গোলামের বক্তব্য ছাপে পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকা।
৪ ও ৫. প্রসঙ্গ:রাজাকার ও আল-বদরের মাধ্যমে সামরিক সহযোগিতার দায়
জামাতের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক এবং সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডে সমর্থনসূচক সংহতিপত্র ঘোষণার পরদিনই অর্থাৎ ২২ আগস্ট ‘রাজাকার অধ্যাদেশ’ ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার । এই অধ্যাদেশ বলে আনসার বাহিনী বিলুপ্ত করে এর যাবতীয় তহবিল, সম্পদ, এবং সুযোগ সুবিধা রাজাকার বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা হয়।
বিস্তারিত: লিঙ্ক
অধ্যাদেশে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে ভবিষ্যতে রাজাকারদের পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এটা ভাবা ভুল হবে যে এই অধ্যাদেশ ঘোষণার পর রাজাকার বাহিনী গঠন শুরু হয়। বরং এটি দিয়ে রাজাকারদের সেনাবাহিনীর সহযোগী সংগঠন হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয়। এই রাজাকাররা এতদিন ছিলো জামাতে ইসলামীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি সশস্ত্র দলমাত্র।
‘৭১এর মে মাসে খুলনা শাহজাহান আলী রোডে অবস্থিত আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মীকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীর সূচনা করে জামায়াত নেতা মওলানা একেএম ইউসুফ। এই আনসার ক্যাম্পই পরে অধ্যাদেশবলে রাজাকার সদর দফতর হিসেবে ঘোষিত হয়। শুরুতে এই বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামাতের ছাত্র সংগঠন যার নাম এখন ইসলামী ছাত্র শিবির) সভাপতিকে। রাজাকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে আনসার অধ্যাদেশকে সংশোধন করে এই বাহিনীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আত্মীকরণ করা হয়। এই বাহিনীকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়, আল-শামস ও আল-বদর। অছাত্র, বয়স্ক, অর্ধ শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতদের নিয়ে আল-শামস গঠন করা হয়। এদের মধ্যে জামায়াতিরাই ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। আল-বদর গঠন করা হয় শুধু ইসলামী ছাত্র সংঘের ছাত্রদের নিয়ে যাদের আরেকনাম ছিলো ইসলামী জমিয়াতুল তালিবা। এরা ছিলো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘাতক দল। আল-শামস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানের পাশাপাশি রাস্তা,পুল পাহারা দিতো অন্যদিক আল-বদরের দায়িত্ব ছিলো স্পেশাল মিশন। আর সেই বিশেষত্ব তারা দেখিয়েছে দেশ স্বাধীনের আগে আগে বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে। প্রসঙ্গত, আল-বদরও কিন্তু একটি আঞ্চলিক বাহিনী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলো। ময়মনসিংহ ছাত্র সংঘের সভাপতি আশরাফ হোসাইন জামালপুরে এ বাহিনী গঠন করে ২২ এপ্রিল (যদিও ভিন্ন সূত্রে এই বাহিনীর গঠনকাল উল্লেখ করা হয়েছে ২৭ জুন বলে)। রাজাকার বাহিনীতে জামায়াতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর ছাত্রসংঘ আলাদা হয়ে যায় আল-বদর নাম নিয়ে।
সাধারন নাগরিকদের সশস্ত্র করে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় চরদের (দুটোই মুক্তিযোদ্ধাদের জামায়াতি সম্বোধন) দমন করার আবেদন জামায়াত শুরু থেকেই করে আসছিলো। রাজাকার অধ্যাদেশের আগেই এধরণের ঘাতক বাহিনী গঠন করলেও এদের সরকারী স্বীকৃতির জন্য মরিয়া ছিলো তারা, কারণ তাদের পরিকল্পনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার যে নীল নকশাটি ছিলো তা অন্যভাবে বাস্তবায়ন করলে আইনী ঝামেলায় পড়ার সমূহ সম্ভাবনা (যে বিপদে এখন জামায়াত নেতারা পড়েছে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনালে) ছিলো। এ কারণেই দলীয় ক্যাডারদের সরাসরি সামরিক বাহিনীর তত্বাবধানে ট্রেনিং দেওয়ার আবেদন জানিয়েছে গোলাম আযম তার বিভিন্ন বক্তৃতায় এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামও এ নিয়ে অনেকবার সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। উদাহরণ দেওয়া যাক,২০ জুন লাহোরে জামায়াতের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন আহবান করে গোলাম। সেখানে সে বলে, the authorities should win the confidence of the people in East Pakistan. The citizens should feel confident and should know that they were trusted by the administration. He also said that miscreants were still active there and to counter their activities, peace loving citizens should be armed for their own defence.’ (The Morning News, 21 June 1971).
একই দিন একই বিষয়ে দৈনিক সংগ্রাম ‘গোলাম আযমের সংবাদ সম্মেলন’ শিরোনামে লেখে: ‘পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠা ও দুষ্কৃতিকারীদের উচ্ছেদের ব্যাপারে অধ্যাপক গোলাম আযম তার সাংবাদিক সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেছেন। তিনি দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবেলার উদ্দেশ্যে দেশের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। সুতরাং দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবেলায় দেশের আদর্শ সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের কর্মতৎপরতাকে অধিকতর ফলপ্রসূ করে তোলার উল্লেখিত প্রস্তাবটিকে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখবেন বলে আমাদের বিশ্বাস আছে।’ বিবৃতিতে ঢালাওভাবে বলা হলেও পরবর্তীতে অনেক বক্তৃতায় পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী হিসেবে শুধুমাত্র জামাতকেই মেনেছে গোলাম। মূলত দলীয় বাহিনীকে সামরিক লেবাস পড়াতে ইয়াহিয়ার ছাড়পত্র আনতেই সেবার পাকিস্তানে গিয়েছিলো গোলাম। আর তার প্রমাণ পাওয়া যায় জুনের শেষ সপ্তাহেই রাজাকারদের অস্ত্র সজ্জিত ও ট্রেনিং দেওয়ার সামরিক অনুমোদন, যার কথা উপরে শান্তি কমিটি সাক্ষরিত দলিলটিতে বলা হয়েছে
দৈনিক সংগ্রামও এ ব্যাপারে নিয়মিতই সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় ছেপেছে। রাজাকার-আলবদরের প্রাথমিক আইডিয়াটা প্রকাশনায় আসে মূলত তাদের তরফেই। এ ব্যাপারে ২৮ মে ‘বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামের সম্পাদকীয়টি বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সেখানে লেখা হয়: ‘দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত এসব দুষ্কৃতিকারী দমনের ব্যাপারে আমরা ইতিপূর্বেও সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় একাধিক নিবন্ধে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস পাকিস্তান ও জাতীয় আদর্শে বিশ্বাসী নির্ভরযোগ্য লোকদের সমন্বয়ে একটি বেসামরিক পোষাকধারী বাহিনী গঠন করে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে অতি তাড়াতাড়ি এসব দুষ্কৃতিকারীকে নির্মূল করা সহজ হবে।’
রাজাকারদের একটি অধ্যাদেশের আওতায় আনার জন্য জামায়াতের চাপের নজির আরো পাওয়া যাবে। যেমন ১ আগস্ট পিরোজপুরে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের এক সমাবেশে ইসলাম পন্থী জনগণকে সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়ার দাবি জানানো হয়। অথচ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে তাদের ট্রেনিং চলছিলো জুনের শেষভাগ থেকেই। ১৭ জুলাই পাকিস্তান অবজারভার টাঙ্গাইলে রাজাকারদের ট্রেনিং দেখতে যাওয়া নিয়াজীর একটি ছবি ছাপে। ৪ জুলাই সংগ্রামের প্রথম পাতার প্রথম কলামে ‘আজ বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে রাজাকারদের গুলি চালানোর ট্রেনিং’ শিরোনামে লেখা হয়: ‘যেসব রাজাকার ট্রেনিং গ্রহণ করছেন আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে তাদেরকে ক্ষুদ্র অস্ত্রের সাহায্য গুলি চালনা শিক্ষা দেওয়া হবে।’ ৯ জুলাই জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেকের বরাতে ‘জনগন ভারতে অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী ও ডাকাতদের নির্মূলের জন্য জনগন এখন স্বেচ্ছায় রাজাকার ট্রেনিং নিচ্ছে’। ২৬ জুলাই আরেকটি সম্পাদকীয়তে রাজাকারদের প্রশংসা করে লেখা হয় ‘ইতিমধ্যে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় রেজাকার বাহিনী গঠিত হয়ে তারা দুষ্কৃতিকারীদের দমনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যেসব স্থানে রেজাকার বাহিনী গঠিত হয়নি, সেসব স্থানেও শিগগিরই গঠিত হতে যাচ্ছে।… দুষ্কৃতিকারীদের দমনে যাতে আদৌ সেনাবাহিনী ব্যবহারের প্রয়োজন না হয়সে লক্ষ্য নিয়েই জনগন ও অন্যান্য সংস্থাকে পারস্পরিক সহযোগিতা সহকারে কাজ করে যেতে হবে।’ ৪ আগস্ট ‘রাজাকার বাহিনীর প্রথম গ্রুপের ট্রেনিং সমাপ্ত’ শিরোনামে খবর ছাপায় সংগ্রাম।
পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাপ্রধান লে.জেনারেল নিয়াজী তার ‘The Betrayal of East Pakistan’ বইয়ে লিখেছেন
The proposal for raising an organised Razakar Force remained under consideration with HQ, CMLA and GHQ for a long time. Although their recruitment had started earlier, sanction for the raising of this force was given at the end of August 1971….A separate Razakars Directorate was established, and the whole set up started taking proper shape. Two separate wings called Al-Badr and AL-Shams were organised. Well educated and properly motivated students from the schools and madrasas were put in Al-Badr wing, where they were trained to undertake ‘Specialised Operations’, while the remainder were grouped together under Al-Shams, which was responsible for the protection of bridges, vital points and other areas,
রাজাকার এবং আল-বদর যে জামাতে ইসলামী ও তার ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণে ছিলো এর স্বপক্ষে ভুড়িভুড়ি প্রমাণ পাওয়া যায়। সাবেক পাকিস্তানী জেনারেল হাকিম আহমেদ কোরেশী The IndoPak War নামে একটি বই লিখেছেন, ২০০২ সালে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত বইটির পৃষ্টা ৯১য়ে লেখা হয়েছে:
Maulana Tufail Muhammad of the Jamaat-e-Islami visited us after the military action. He was, I think, the only leader of national stature from West Pakistan who took the trouble of travelling to the remote corners of East Pakistan to make a personal assessment of the prevailing conditions. It was good to know that, besides men in uniform, there were others equally concerned about the future of this ideologically and geographically unique country. The Maulana was particularly concerned about the performance of the Razakars, (volunteers) locally recruited and belonging to his party, and was happy to learn that their conduct was commendable. He jokingly remarked that his party cadres had always come to the rescue of the Army in tough situations, but my state of mind at the time was not receptive to this light-hearted observation; I thought it limited the scope of co-operation between Jamat and the Army. In fact, neither was the Army acting to preserve itself, nor the mujahids to perpetuate army rule; they were co-operating in the national interest, not doing each other any favours. Let it be said, to the credit of Jamat-i-Islami and these motivated Bengali Muslims, that they stuck it out with us till the end. They were prepared to go all the way to their graves in the name of Islam and Pakistan; unfortunately we decided to raise the white flag.
[ সামরিক হস্তক্ষেপের পর জামায়াতে ইসলামীর মওলানা তোফায়েল মোহাম্মদ আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমার ধারণা জাতীয় পর্যায়ের তিনিই একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা যিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ঘুরে সেখানকার সার্বিক অবস্থা অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। জেনে ভালো লাগলো যে সামরিক উর্দির বাইরেও এদেশের আদর্শিক ও ভৌগলিক একতা নিয়ে ভাবার মতো অন্যরাও আছে। মাওলানার যাবতীয় উদ্বেগ দেখা গেলো রাজাকাররা কেমন করছে তা নিয়ে, কারণ এসব স্বেচ্ছাসেবকরা স্থানীয় পর্যায়ে অধিভুক্ত এবং তার দলের সদস্য। তাদের কার্যক্রমের প্রশংসা শুনে বেশ খুশীই হলেন তিনি। মজা করে বললেন তার দলের ক্যাডাররা বরাবরই সামরিক বাহিনীকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে অভ্যস্ত। কিন্তু আমার মন তখন এসব রসিকতা বোঝার মতো অবস্থায় ছিল না। বরং মনে হচ্ছিল এতে জামায়াত এবং সেনাবাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতায় সীমাবদ্ধতা তৈরী হচ্ছে। বাস্তবে সেনাবাহিনী যেমন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়ছিল না, তেমনি এসব মুজাহিদরাও তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করছিল না। তারা জাতীয় স্বার্থেই পরস্পরকে সহযোগিতা করছিল, কেউ কারো উপকার করছিল না। তবে জামায়াতে ইসলামী এবং এসব উজ্জীবিত বাঙালী মুসলমানদের প্রশংসা করে বলতেই হয় যে তারা আমাদের সঙ্গে একদম শেষ পর্যন্ত লেগে ছিল।ইসলাম এবং পাকিস্তানের জন্য তারা মরতেও প্রস্তত ছিল কিন্তু দূর্ভাগ্য যে আমরা আত্মসমর্পন করে ফেললাম।]
এ ব্যাপারে সবচেয়ে চমকপ্রদ উদ্ধৃতিটি আসলে ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) সিদ্দিক সালিকের। উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে যুদ্ধবন্দী এই পাকিস্তানী সেনাকর্মকর্তা লিখেছেন: ‘In September 1971 a political delegation from erstwhile West Pakistan complained to General Niazi that he had raised an army comprising men nominated by Jamaat-e-Islami. …The general [Niazi] called me to his office and said: From now on, you will call the Razakars — Al-Badr and Al Shams — to give the impression that they do not belong to one single party.” [page; 105]
ভাবানুবাদ হচ্ছে:
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক প্রতিনিধিদলের সদস্যরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে অভিযোগ করে যে তিনি জামাতে ইসলামী মনোনীতদের নিয়ে একটি সামরিক বাহিনী গঠন করেছেন। জেনারেল আমাকে তার অফিসে ডেকে নির্দেশ দিলেন, এখন থেকে তুমি রাজাকারদের আল-বদর ও আল শামস বলে অভিহিত করবে যাতে বোঝা যায় এরা কোনো একটি সুনির্দিষ্ট দলের সদস্য নয়। যে অভিযোগের উল্লেখ সিদ্দিক সালিক করেছেন সেটি মোটেও হালকা কিছু নয়।
সালিক যা বলেছেন সেই অভিযোগ এসেছিলো পিপলস পার্টির তরফে। সেবার পূর্ব পাকিস্তান সফর করে এসে মাহমুদ আলি কাসুরি অভিযোগ করেন জামায়াতে ইসলামী ক্যাডাররা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিশ্চিহ্ন করার কাজে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করছে। এ ব্যাপারে পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ডানপন্থী রাজাকাররা বামপন্থীদের হত্যা করছে।’ এর প্রতিবাদ করেন মুসলিম লীগ (কাইয়ুম)প্রধান খান কাইয়ুম খান। ৬ সেপ্টেম্বর ‘অপবাদ মূলত সামরিক সরকারকেই দেওয়া হচ্ছে’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘যে রেজাকারদের সর্বদলীয় শান্তি কমিটির সহযোগিতায় সামরিক সরকারই বাছাই করেছেন এবং ট্রেনিং দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগিয়েছেন, তারা কি করে দল বিশেষের পক্ষ হয়ে অন্যান্য দলের কর্মীদের খতম করেছে তা ভাবতেই অবাক লাগে। অপবাদ কি মূলত সামরিক সরকারকেই দেওয়া হচ্ছে না?’
অক্টোবরে এই বিতর্ক আবার শুরু হয়। ১১ অক্টোবর বার্তা সংস্থা রয়টার্স সংবাদ পরিবেশন করে ‘PEOPLE’S PARTY LEADER ADMITS RAZAKAR TERROR’ শিরোনামে, যেখানে লেখা হয়: A leading People’s Party official dropped out of a party delegation hours before it left for East Bengal, alleging that power in the eastern wing had been handed over to reactionary and anti-people parties who had massacred political opponents. Meiraj Mohammed Khan, the party’s Karachi secretary, said yesterday (October 10) that he felt it was “futile for me to go”.
The 10-man party delegation was scheduled to go to Dacca to survey the situation in view of forthcoming by-elections for 78 seats formerly held by mem¬bers of the Awami League.
Meiraj alleged that in East Bengal “power in effect has been transferred to those reactionary and anti-people political parties defeated in the elections and rejected by the people”.
He named one party-the Muslim Jammaat-e-Islami group-of indulging in wholesale massacre of political opponents for which they are using their Razakars.
এমন নয় যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানেই এনিয়ে বিতর্ক উঠেছিলো। জামাতে ইসলামী যে রাজাকারদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে সে অভিযোগ উঠেছিলো জামাতের রাজনৈতিক সহযোগী দলগুলোর মধ্যেও। তার প্রমাণ মেলে পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক গোয়েন্দা নথিতে । ৩ অক্টোবর নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) নির্বাহী কমিটির এক জরুরী সভায় পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা ও নৈরাজ্যের জন্য জামাতে ইসলামী এবং রাজাকারদের দায়ী করে বক্তৃতা দেয় কজন নেতা। মজার ব্যাপার হচ্ছে রাজাকারদের নিয়ে পিপিপির ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি আর নুরুল আমিনের প্রশংসা নিয়ে ১৩ নভেম্বর একটি সংবাদ ছাপে হামিদুল হক চৌধুরী সম্পাদিত পাকিস্তান অবজারভার। লাহোর থেকে তাদের বিশেষ সংবাদদাতার পাঠানো ‘Row over Razakars: PPP’s Mysterious Seats’ খবরটি মোটামুটি জামাতের লাইনে পরিবেশিত এবং পিপিপিকে একহাত দেখে নেওয়া হয়েছে।
রাজাকারদের সবচেয়ে দূর্ধর্ষ অংশ আল-বদরের সঙ্গে বর্তমান জামাত নেতৃত্বের সম্পর্ক কি? এ প্রসঙ্গে সে সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতৃত্বের তালিকাটা তুলে ধরা জরুরী যারা বাই ডিফল্ট আল বদরেরও শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলো (সূত্র) । তালিকায় চোখ বোলালেই বোঝা যায় এই লোকগুলোই এখন জামাতে ইসলামীর বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত। তাই চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তাদের গ্রেফতার এবং কাঠগড়ায় ওঠানোটা যদি জামাতের শীর্ষ নেতৃত্বকে রাজনৈতিক হেনস্থা বোঝায়, সেটা হবে আরেকটি বড় মিথ্যাচার। বরং এটিই হচ্ছে ঘটনার পর্যায়ক্রমে বাধ্যতামূলকভাবেই প্রত্যাশিত এক প্রক্রিয়ামাত্র। বন্ধু ফখরুল আরেফীন একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন ‘আল-বদর’ নামে যা বর্তমান ট্রাইবুনালে অন্যতম প্রামান্য উপাত্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তার কয়েকটি ফুটেজ এই পোস্টে আমি ব্যবহার করেছি। এর একটি আল-বদর ও জামাত নেতৃত্বের সম্পর্ক নিয়ে যাতে স্পষ্ট এতে আলী আহসান মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামীদের সংশ্লিষ্টতা। প্রখ্যাত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির কনভেনর ডা.এম এ হাসান,সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব কামালের মুখে শোনা যাক:
এবার আসা যাক এ সংক্রান্ত সবচেয়ে অথেনটিক উপাত্তটিতে। ১৯৭১ সালে এই ছাত্র সংঘের সদস্যদের আল-বদর নামের খুনে বাহিনীতে রিক্রুট করার দায়িত্ব ছিলো আইএসআইর মেজর রিয়াজ হুসেইন মালিকের ওপর। বলা হয়, আল-বদর নামটাও তারই দেওয়া। উইকিপিডিয়াতে লেখা হয়েছিলো (অতীতবাচ্যে বললাম কারণ আমার একটা পোস্টে এই উদ্ধৃতিটা ব্যবহার করার পর দেখা গেছে লেখাটা এডিট করে সেখানে বসানো হয়েছে যে যদিও জামাতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন হিসেবে আল বদরদের অভিযুক্ত করা হয়, কিন্তু আসলে তাদের তেমন ট্রেনিং ছিলো না, অস্ত্রও ছিলো না। বরং এদের বেশীরভাগ ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিয়েছে। নাউজুবিল্লাহ!) : The name Al-Badar was given by major Riaz hussain during the passing out ceremony of first Al-badar group. ১৯৯৭ সালে পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে উর্দূতে একটা প্রামান্য চিত্র তৈরি হয় ‘জমিয়াত কি পঞ্চাশ সাল’ নামে। সেই বিশাল প্রামান্যচিত্রে পূর্বপাকিস্তানের ইসলামী জমিয়াতে তালাবা সম্পর্কে রিয়াজ হুসেইনের প্রশংসাধন্য বয়ান মিলে। প্রামান্য চিত্রটির একটা সংক্ষিপ্ত ভার্সন আছে ইউটিউবে। ‘আল-বদর ১৯৭১’ নামে ওই ফুটেজটি পাকিস্তানীদেরই আপলোড করা। সেখানে ভূমিকায় সমাজতান্ত্রিক ও সেক্যুলার ছাত্রদের (ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন) মোকাবেলায় যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে আইজেটিকেই মানা হয়। এবং এসব প্রগতিশীল ছাত্ররা যখন মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে সক্রিয়, তখন তাদের ঠেকাতে ছাত্রসংঘের বন্দুক ধরাও ফরজ বিবেচিত হয়েছে। রিয়াজ হুসেইন উর্দুতে কয়েকটা ঘটনার বর্ননা দিয়া এদের মাহাত্ম প্রচার করেছে এবং শুরুতেই উল্লেখ করেছে ইসলামী ছাত্রসংঘের নাম, তাদের ইসলাম প্রেম ও পাকিস্তান প্রেম। বিভিন্ন কাহিনীর মধ্যে রয়েছে একজন ছাত্রসংঘ সদস্য নাকি তার আপন ভাইকে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়েছে সে মুক্তিবাহিনী এবং সুবাদে ভারতের দালাল বিধায়। তার যুক্তি এমন ভাইয়ের মরে যাওয়াই উচিত যে তার কোটি মুসলমান ভাইর সঙ্গে বেইমানি করছে! আরেকজন মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত ভাইয়ের জানাজা পড়েই (সে জানাজায় নাকি রিয়াজও ছিলো) আবার ডিউটিতে হাজির। এরকমই নানা গল্পের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের গুণ কীর্তন করা হয়েছে।
পাকিস্তানের জমিয়াতে তালাবার ওয়েবসাইটেও রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগঠনটির বীরত্বের কথা। তখনকার গোটা পাকিস্তানের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সম্পর্কে সেখানে লেখা হয়েছে:
Motiur Rahman Nizam is the current chief (Ameer) of the Jamaat-e-Islami Bangladesh, which is the largest Islamic political party in Bangladesh. Nizami rose in the ranks of the Jamaat-e-Islami in East Pakistan in the 1960s, after being a leader of a student organization, Islamic Chhatro Shango (now Islami Chhatro Shibir). During the liberation war of 1971, Nizami actively supported the cause of West Pakistan and formed the Al-Badr Force in which he acted as the supreme commander of the Al-Badr Militia.
আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ মানা যেতে পারে ইসলামী ছাত্রসংঘের সাবেক সদস্য এবং ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মিসবাহউর রহমান চৌধুরীর মতিউর রহমান নিজামীকে অভিযুক্ত করে দেওয়া বক্তব্য এবং আল-বদর গঠন সংক্রান্ত ছাত্রসংঘের একটি নির্দেশনামাকে।এক টিভিসাক্ষাতকারে মিসবাহ সে সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদরদপ্তর থেকে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে পাঠানো একটি চিঠি তুলে ধরেছেন যেখানে লেখা হয়েছে:
‘আগামী ১০ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্র সংঘের সকল নেতাকর্মীকে আল-বদর বাহিনীতে যোগদানের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হইয়াছে। ১০ আগস্ট আপনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মৌলভীবাজার কমান্ডের অফিসে সকাল ১০টার মধ্যে মেজর ফখরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাত করিয়া যোগদানপত্র গ্রহণ করিবেন।’
বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ডে উস্কানী দিয়ে গোলাম আযাম ও জামায়াতের মুখপাত্র সংগ্রামের প্রচুর উপসম্পাদকীয় ও বিবৃতির খোজ মেলে। তার কয়েকটি তুলে ধরা যাক। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে ‘সম্পাদক সমীপেষু’ কলামে আব্দুল বারী নামে এক আলবদর কমান্ডারের এই চিঠিটি ছাপা হয় :
জনাব,
স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আলবদর বাহিনীর নাম আজ প্রদেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে পৌঁছে গেছে। গত ২৭ জুন জামালপুর মহকুমায় আলবদর বাহিনী গঠিত হবার পর আজ সমগ্র মোমেনশাহী জেলা ও প্রদেশের আরো দুয়েকটি জেলায় এর কাজ শুরু হয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আলবদর বাহিনী পাকিস্তানবাদী ইসলামপন্থী দেশপ্রেমিক ছাত্রদের দ্বারা গঠিত। এতে ইস্কুলের ১২ বছরের ছেলে থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র রয়েছে।
যতদূর জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে জামালপুর মহকুমাতেই পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। এখানে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ৪০% থেকে ৫০% ছেলে পরীক্ষা দিয়েছে। জামালপুর মহকুমার শেরপুর, নলিতাবাড়ি, ইসলামপুর, দেওয়ান গঞ্জ ও জামালপুর শহরে দুষ্কৃতিকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে।
জামালপুরের বিভিন্ন জায়গায় সীমান্তবর্তী এলাকায় আলবদর বাহিনী সাহসিকতা ও সাফল্যের সঙ্গে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের মোকাবেলা করেছে। আলবদর বাহিনীর তৎপরতা দেখে ভারতীয় অনুচর নাপাক বাহিনীর লোকেরা জামালপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে বলে ক্রমাগত সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আলবদর বাহিনীর বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রতিটি ছেলেই শিক্ষিত এবং নামাজ পড়ে। ধনসম্পদ ও নারীর প্রতি কোনো লোভ নেই। বদর বাহিনীর গত তিনমাসের কাজে কোনো চারিত্রিক দূর্বলতা দেখা যায়নি। এজন্যই জনগণের কাছে আশার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের প্রিয় নাম আলবদর। জামালপুরে রেজাকার, পুলিশ, মুজাহিদ ও রেঞ্জাররা পুল ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পাহারা দিচ্ছে আর পাক ফৌজ ও আলবদর বাহিনী অপারেশন করছে।
আমি পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক ইসলামপন্থী ছাত্রজনতার কাছে আহবান জানাচ্ছি সামরিক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ও সাহায্য নিয়ে দ্রুত প্রদেশের সর্বত্র আলবদর বাহিনী গঠন করতে। বদর বাহিনী ছাড়া শুধু রেজাকার ও পুলিশ দিয়ে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি আয়ত্বে আনা সম্ভব নয়। আমাদের কাছে রেজাকার, বদর বাহিনী ও মুজাহিদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমরা সবাইকে মনে করি সমান। ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও তার দালালদের শায়েস্তা করতে আজ তাই প্রদেশের সর্বত্র আলবদর বাহিনী গঠন করা প্রয়োজন।
দেশের বর্তমান নাজুক ও সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে যত তাড়াতাড়ি আলবদর বাহিনী প্রদেশের সর্বত্র গঠিত হয় ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল। আল্লাহ আমাদের তার পথে কাজ করা তৌফিক দান করুন। আমিন।মোহাম্মদ আব্দুল বারী
ইনচার্জ, আলবদর ক্যাম্প, ইসলামপুর থানা, মোমেনশাহী
ও প্রচার সম্পাদক, জামালপুর মহকুমা শান্তি কমিটি
স্বাধীনতার পর এই আব্দুল বারীর ব্যক্তিগত ডায়েরিটি উদ্ধার করা হয়। সেখানে মিলে চিঠির সঙ্গে বদরদের চারিত্রিক গুণাবলীর অসঙ্গতির চিত্র। ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে মুদ্রিত ডায়েরির প্রধান বিবরণগুলি হচ্ছে :
টাঙ্গাইলে successful operation হয়েছে। হাজার দেড়েকের মতো মুক্তিফৌজ মারা পড়েছে আলবদর ও আর্মির হাতে।
1.Haidar Ali 2. Nazmul Haque. Rs 2500.00
তিতপল্লার শিমকুড়া গ্রাম- জব্বারের কাছে ২৯/১০/৭১ আর তিন হাজার নেওয়ার পরিকল্পনা আছে
24-10-71… … Prostitution Quarter
26-10-71… Raping Case… Hindu Girl
আল-বদরদের একদম স্পেসিফিক মিশনই ছিলো দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা। এটি যত না পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তার চেয়েও বেশী ছিলো জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব এজেন্ডা। কারণ যেসব মিথ্যাকে অবলম্বন করে তারা রাজনীতি করে তার মুখোশটা সহজেই খুলে দেওয়ার ক্ষমতা এই বুদ্ধিজীবিরা রাখতেন। দেশের জনগনের একটা বড় অংশই অশিক্ষিত বলে এদের ধর্মের দোহাই দিয়ে বশে রাখা যায়, শিক্ষিতদের সেটা সম্ভব নয়। জামায়াত-শিবির মিথ্যা অপপ্রচার এবং ঘটনা বিকৃত করে নিজের ফায়দায় কাজে লাগানোর যে চর্চায় অভ্যস্ত যুগ যুগ ধরে তা বজায় রাখতে এদের নিশ্চিহ্ন করাটা তাই জরুরী ছিলো। আগেই বলেছি এ ব্যাপারে অজস্র এবং অসংখ্যবার উস্কানী এসেছে গোলাম আযমসহ জামায়াতের বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। এ প্রসঙ্গে নীচে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত কিছু সংবাদ ও সম্পাদকীয়র অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো। তাতেই পাঠক প্রমাণ পাবেন গোলাম আযম, জামাতের শীর্ষ নেতৃত্ব কোনোভাবেই রাজাকার এবং আল-বদরদের সংগঠিত এবং ব্যবহার করে এসব হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। এবং যুদ্ধাপরাধ আদালতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো অভিযুক্তের উপস্থিতি ছাড়াই স্রেফ এই একটি সুনির্দিষ্ট গণহত্যার অপরাধেই তাদের প্রত্যেকের শাস্তি হতে পারে।
২ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম এক সম্পাদকীয়তে গোলাম আযমের সুপারিশ মেনে বেসামরিক পাকিস্তানপন্থীদের সশস্ত্র করার জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানায়। সে লেখায় মওলানা আবদুর রহিমের বরাতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রোপোগান্ডা চালানোর জন্য বিভিন্ন সরকারী অফিসের কর্মচারীদের অভিযুক্ত করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবাষিকীতে কার্জন হলে ইসলামী ছাত্র সংঘের এক অনুষ্ঠানে আল-বদরদের আগমনী উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা বার্তা শোনা যায় গোলামের কণ্ঠে:
২৩ সেপ্টেম্বর মতিউর রহমান নিজামী কোনো রাখঢাক না করেই সুস্পষ্ট অভিযোগের আঙুল তোলে বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে। ইসলামিক একাডেমিতে আয়োজিত সিরাত সম্মেলনে গোলাম আযমের উপস্থিতিতে পাকিস্তান ছাত্রসংঘ প্রধান বলে, যারা ইসলামকে ভালোবাসে, শুধু মাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালোবাসে। এবারের উদঘাটিত এই সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবিরা ভুলে যেতে না পারেন, সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
১০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভারতের দালাল ও বিশ্বাসঘাতকদের খুজে বের করে হত্যা করার যুক্তি দেয় দৈনিক সংগ্রাম ‘বাবুদের আরেক রূপ’ শিরোনামে:
১২ নভেম্বর ‘রোকেয়া হলের ঘটনা’ শিরোনামে এক উপসম্পাদকীয়তে আবারও অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা সন্দেহজনকদের খুজে বের করে হত্যার কথা বলে সংগ্রাম:
১৪ নভেম্বর মতিউর রহমান নিজামির লেখা ‘পাকিস্তান ও আল বদর’ নামে একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সংগ্রামে। সেখানে নিজামী লেখে:
… আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকসেনার সহযোগিতায় এ এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্র সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল তিনশত তের। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যোদ্ধাদের সেইসব গুণাবলীর কথা আমরা আলোচনা করেছি, আলবদর তরুণ মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাল্লাহ সেই সর্বগুণাবলী আমরা দেখতে পাব।
পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গঠিত আলবদরের যুবকেরা এবারে বদর দিবসে নতুন করে শপথ নিয়েছে, তাদের তেজোদ্দীপ্ত কর্মীদের তৎপরতার ফলেই বদর দিবসের কর্মসূচী দেশবাসী তথা দুনিয়ার মুসলমানদের সামনে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে। ইনশাল্লাহ, বদর যুদ্ধের বাস্তব স্মৃতিও তারা তুলে ধরতে সক্ষম। তরুণ যুবকরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে।’
একই সংখ্যায় আলী আহসান মুজাহিদ লেখে ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র, যুক্ত নয় নামে একটি প্রবন্ধ। ২৩ নভেম্বর সারাদেশে জরুরী অবস্থা জারী করে ইয়াহিয়া সরকার। এ সময়ই মাঠে নামে আল-বদর। এর আগে তারা তাদের টার্গেট বুদ্ধিজীবিদের একটি চিঠি পাঠায়। শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেনের পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠিতে লেখা ছিলো:
শয়তান,
ব্রাক্ষণ্যবাদী হিন্দুদের যেসব পা চাটা কুকুর আর ভারতীয় ইন্দিরাবাদের দালাল নানা ছুতানাতায় মুসলমানদের বৃহত্তম আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তুমি তাদের অন্যতম। তোমার মনোভাব, চালচলন ও কাজকর্ম কোনোটাই আমাদের অজানা নেই। অবিলম্বে হুশিয়ার হও এবং ভারতের পদলেহন থেকে বিরত হও, না হয় তোমার নিস্তার নেই। এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।
শনি
১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা হত্যাকান্ডের অপারেশন ইন চার্জ ছিলো চৌধুরী মঈনউদ্দিন , যে এখন ইংল্যান্ডে বসে বিরাট ধর্মীয় নেতা বনে গেছে। আর মূল ঘাতকের ভূমিকায় ছিলো আশরাফুজ্জামান , যে এখন নিউইয়র্কে এক মসজিদে ইমামতি করছে। স্বাধীনতার পর মোস্ট ওয়ান্টেড এই দুজন এখন ইসলাম বিক্রি করে খাচ্ছে বিদেশে। এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতা হিসেবেই।
আল-বদরদের মাটিলেপা মাইক্রোর (যেটি করে তারা বুদ্ধিজীবিদের তুলে নিয়ে আসতো) ড্রাইভারের স্বীকারোক্তিতে জানা যায় ইসলামী ছাত্র সংঘের হাই কমান্ডের কার কি ভূমিকা। ক’দিন পর ধরা পড়া জামাতের প্রচার সম্পাদক (বর্তমানে আধুনিক প্রকাশনীর দায়িত্বে এবং বাংলাদেশের বেশ ক’জন উঠতি বুদ্ধিজীবির দেখাশোনা করে) আবদুল খালেক তার জবানবন্দীতে স্বীকার করে ইসলামী ছাত্র সংঘের এই ভয়াবহ নীলনক্সা।
এতো নৃশংস নির্মমতার সঙ্গে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়েছে যে অনেকের লাশের হদিসও মেলেনি। আজ, এই চল্লিশ বছর বুকে পাথর বেধে রাখা শহীদের স্বজনরা সেই হত্যাকান্ডের বিচারের উপলক্ষ্য পেয়েছে। তা ভন্ডুলের চেষ্টা চলবে, কিন্তু অস্বীকার করার প্রবণতা আমরা রুখে দেবো। মাথায় টুপি পড়ে, হাতে কোরান নিয়ে যারা গণহত্যায় নামতে পারে, তারা মুসলমান নয়, মোনাফেক। এরা মিথ্যেবাদী প্রতারক। এদের রেহাই আল্লাহ এই দুনিয়াতেও দেননি।
লেখকঃ অমি রহমান পিয়াল