গোলাম নামা: আত্মপক্ষ সমর্থনের নামে ব্যাপক মিথ্যাচার-২

গোলাম নামা: আত্মপক্ষ সমর্থনের নামে ব্যাপক মিথ্যাচার-২

 

৪ ও ৫. প্রসঙ্গ:রাজাকার ও আল-বদরের মাধ্যমে সামরিক সহযোগিতার দায়

জামাতের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক এবং সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডে সমর্থনসূচক সংহতিপত্র ঘোষণার পরদিনই অর্থাৎ ২২ আগস্ট ‘রাজাকার অধ্যাদেশ’ ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার । এই অধ্যাদেশ বলে আনসার বাহিনী বিলুপ্ত করে এর যাবতীয় তহবিল, সম্পদ, এবং সুযোগ সুবিধা রাজাকার বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা হয়।

সেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে ভবিষ্যতে রাজাকারদের পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এটা ভাবা ভুল হবে যে এই অধ্যাদেশ ঘোষণার পর রাজাকার বাহিনী গঠন শুরু হয়। বরং এটি দিয়ে রাজাকারদের সেনাবাহিনীর সহযোগী সংগঠন হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয়। এই রাজাকাররা এতদিন ছিলো জামাতে ইসলামীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি সশস্ত্র দলমাত্র।

 

‘৭১এর মে মাসে খুলনা শাহজাহান আলী রোডে অবস্থিত আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামাত কর্মীকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীর সূচনা করে মওলানা একেএম ইউসুফ। এই আনসার ক্যাম্পই পরে অধ্যাদেশবলে রাজাকার সদর দফতর হিসেবে ঘোষিত হয়। শুরুতে এই বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামাতের ছাত্র সংগঠন যার নাম এখন ইসলামী ছাত্র শিবির) সভাপতিকে। রাজাকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে আনসার অধ্যাদেশকে সংশোধন করে এই বাহিনীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আত্মীকরণ করা হয়। এই বাহিনীকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়, আল-শামস ও আল-বদর। অছাত্র, বয়স্ক, অর্ধ শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতদের নিয়ে আল-শামস গঠন করা হয়। এদের মধ্যে জামাতিরাই ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। আল-বদর গঠন করা হয় শুধু ইসলামী ছাত্র সংঘের ছাত্রদের নিয়ে যাদের আরেকনাম ছিলো ইসলামী জমিয়াতুল তালিবা। এরা ছিলো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘাতক দল। আল-শামস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানের পাশাপাশি রাস্তা,পুল পাহারা দিতো অন্যদিক আল-বদরের দায়িত্ব ছিলো স্পেশাল মিশন। আর সেই বিশেষত্ব তারা দেখিয়েছে দেশ স্বাধীনের আগে আগে বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে। প্রসঙ্গত, আল-বদরও কিন্তু একটি আঞ্চলিক বাহিনী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলো। ময়মনসিংহ ছাত্র সংঘের সভাপতি আশরাফ হোসাইন জামালপুরে এ বাহিনী গঠন করে ২২ এপ্রিল (যদিও ভিন্ন সূত্রে এই বাহিনীর গঠনকাল উল্লেখ করা হয়েছে ২৭ জুন বলে)। রাজাকার বাহিনীতে জামাতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর ছাত্রসংঘ আলাদা হয়ে যায় আল-বদর নাম নিয়ে।

 

সাধারন নাগরিকদের সশস্ত্র করে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় চরদের (দুটোই মুক্তিযোদ্ধাদের জামাতি সম্বোধন) দমন করার আবেদন জামাত শুরু থেকেই করে আসছে। রাজাকার অধ্যাদেশের আগেই এধরণের ঘাতক বাহিনী গঠন করলেও এদের সরকারী স্বীকৃতির জন্য মরিয়া ছিলো তারা, কারণ তাদের পরিকল্পনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার যে নীল নকশাটি ছিলো তা অন্যভাবে বাস্তবায়ন করলে আইনী ঝামেলায় পড়ার সমূহ সম্ভাবনা (যে বিপদে এখন গোলাম ও জামাত পড়েছে যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনালে) ছিলো। এ কারণেই দলীয় ক্যাডারদের সরাসরি সামরিক বাহিনীর তত্বাবধানে ট্রেনিং দেওয়ার আবেদন জানিয়েছে গোলাম আযম তার বিভিন্ন বক্তৃতায় এবং জামাতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামও এ নিয়ে অনেকবার সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। উদাহরণ দেওয়া যাক,২০ জুন লাহোরে জামাতের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন আহবান করে গোলাম। সেখানে সে বলে, the authorities should win the confidence of the people in East Pakistan. The citizens should feel confident and should know that they were trusted by the administration. He also said that miscreants were still active there and to counter their activities, peace loving citizens should be armed for their own defence.’ (The Morning News, 21 June 1971).

একই দিন একই বিষয়ে দৈনিক সংগ্রাম ‘গোলাম আযমের সংবাদ সম্মেলন’ শিরোনামে লেখে: ‘পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠা ও দুষ্কৃতিকারীদের উচ্ছেদের ব্যাপারে অধ্যাপক গোলাম আযম তার সাংবাদিক সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেছেন। তিনি দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবেলার উদ্দেশ্যে দেশের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। সুতরাং দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবেলায় দেশের আদর্শ সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের কর্মতৎপরতাকে অধিকতর ফলপ্রসূ করে তোলার উল্লেখিত প্রস্তাবটিকে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখবেন বলে আমাদের বিশ্বাস আছে।’ বিবৃতিতে ঢালাওভাবে বলা হলেও পরবর্তীতে অনেক বক্তৃতায় পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী হিসেবে শুধুমাত্র জামাতকেই মেনেছে গোলাম। মূলত দলীয় বাহিনীকে সামরিক লেবাস পড়াতে ইয়াহিয়ার ছাড়পত্র আনতেই সেবার পাকিস্তানে গিয়েছিলো গোলাম। আর তার প্রমাণ পাওয়া যায় জুনের শেষ সপ্তাহেই রাজাকারদের অস্ত্র সজ্জিত ও ট্রেনিং দেওয়ার সামরিক অনুমোদন, যার কথা প্রথম পর্বে শান্তি কমিটি সাক্ষরিত দলিলটিতে বলা হয়েছে।

দৈনিক সংগ্রামও এ ব্যাপারে নিয়মিতই সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় ছেপেছে। রাজাকার-আলবদরের প্রাথমিক আইডিয়াটা প্রকাশনায় আসে মূলত তাদের তরফেই। এ ব্যাপারে ২৮ মে ‘বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামের সম্পাদকীয়টি বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সেখানে লেখা হয়: ‘দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত এসব দুষ্কৃতিকারী দমনের ব্যাপারে আমরা ইতিপূর্বেও সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় একাধিক নিবন্ধে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস পাকিস্তান ও জাতীয় আদর্শে বিশ্বাসী নির্ভরযোগ্য লোকদের সমন্বয়ে একটি বেসামরিক পোষাকধারী বাহিনী গঠন করে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে অতি তাড়াতাড়ি এসব দুষ্কৃতিকারীকে নির্মূল করা সহজ হবে।’

রাজাকারদের একটি অধ্যাদেশের আওতায় আনার জন্য জামাতের চাপের নজির আরো পাওয়া যাবে। যেমন ১ আগস্ট পিরোজপুরে জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের এক সমাবেশে ইসলাম পন্থী জনগণকে সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়ার দাবি জানানো হয়। অথচ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে তাদের ট্রেনিং চলছিলো জুনের শেষভাগ থেকেই। ১৭ জুলাই পাকিস্তান অবজারভার টাঙ্গাইলে রাজাকারদের ট্রেনিং দেখতে যাওয়া নিয়াজীর একটি ছবি ছাপে। ৪ জুলাই সংগ্রামের প্রথম পাতার প্রথম কলামে ‘আজ বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে রাজাকারদের গুলি চালানোর ট্রেনিং’ শিরোনামে লেখা হয়: ‘যেসব রাজাকার ট্রেনিং গ্রহণ করছেন আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে তাদেরকে ক্ষুদ্র অস্ত্রের সাহায্য গুলি চালনা শিক্ষা দেওয়া হবে।’ ৯ জুলাই জামাতের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেকের বরাতে ‘জনগন ভারতে অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী ও ডাকাতদের নির্মূলের জন্য জনগন এখন স্বেচ্ছায় রাজাকার ট্রেনিং নিচ্ছে’। ২৬ জুলাই আরেকটি সম্পাদকীয়তে রাজাকারদের প্রশংসা করে লেখা হয় ‘ইতিমধ্যে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় রেজাকার বাহিনী গঠিত হয়ে তারা দুষ্কৃতিকারীদের দমনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যেসব স্থানে রেজাকার বাহিনী গঠিত হয়নি, সেসব স্থানেও শিগগিরই গঠিত হতে যাচ্ছে।… দুষ্কৃতিকারীদের দমনে যাতে আদৌ সেনাবাহিনী ব্যবহারের প্রয়োজন না হয়সে লক্ষ্য নিয়েই জনগন ও অন্যান্য সংস্থাকে পারস্পরিক সহযোগিতা সহকারে কাজ করে যেতে হবে।’ ৪ আগস্ট ‘রাজাকার বাহিনীর প্রথম গ্রুপের ট্রেনিং সমাপ্ত’ শিরোনামে খবর ছাপায় সংগ্রাম।

পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সেনাপ্রধান লে.জেনারেল নিয়াজী তার ‘The Betrayal of East Pakistan’ বইয়ে লিখেছেন “The proposal for raising an organised Razakar Force remained under consideration with HQ, CMLA and GHQ for a long time. Although their recruitment had started earlier, sanction for the raising of this force was given at the end of August 1971….A separate Razakars Directorate was established, and the whole set up started taking proper shape. Two separate wings called Al-Badr and AL-Shams were organised. Well educated and properly motivated students from the schools and madrasas were put in Al-Badr wing, where they were trained to undertake ‘Specialised Operations’, while the remainder were grouped together under Al-Shams, which was responsible for the protection of bridges, vital points and other areas,”

রাজাকার এবং আল-বদর যে জামাতে ইসলামী ও তার ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণে ছিলো এর স্বপক্ষে ভুড়িভুড়ি প্রমাণ পাওয়া যায়। সাবেক পাকিস্তানী জেনারেল হাকিম আহমেদ কোরেশী The IndoPak War নামে একটি বই লিখেছেন, ২০০২ সালে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত বইটির পৃষ্টা ৯১য়ে লেখা হয়েছে: “Maulana Tufail Muhammad of the Jamaat-e-Islami visited us after the military action. He was, I think, the only leader of national stature from West Pakistan who took the trouble of travelling to the remote corners of East Pakistan to make a personal assessment of the prevailing conditions. It was good to know that, besides men in uniform, there were others equally concerned about the future of this ideologically and geographically unique country. The Maulana was particularly concerned about the performance of the Razakars, (volunteers) locally recruited and belonging to his party, and was happy to learn that their conduct was commendable. He jokingly remarked that his party cadres had always come to the rescue of the Army in tough situations, but my state of mind at the time was not receptive to this light-hearted observation; I thought it limited the scope of co-operation between Jamat and the Army. In fact, neither was the Army acting to preserve itself, nor the mujahids to perpetuate army rule; they were co-operating in the national interest, not doing each other any favours. Let it be said, to the credit of Jamat-i-Islami and these motivated Bengali Muslims, that they stuck it out with us till the end. They were prepared to go all the way to their graves in the name of Islam and Pakistan; unfortunately we decided to raise the white flag.”

[ সামরিক হস্তক্ষেপের পর জামায়াতে ইসলামীর মওলানা তোফায়েল মোহাম্মদ আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমার ধারণা জাতীয় পর্যায়ের তিনিই একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা যিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ঘুরে সেখানকার সার্বিক অবস্থা অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। জেনে ভালো লাগলো যে সামরিক উর্দির বাইরেও এদেশের আদর্শিক ও ভৌগলিক একতা নিয়ে ভাবার মতো অন্যরাও আছে। মাওলানার যাবতীয় উদ্বেগ দেখা গেলো রাজাকাররা কেমন করছে তা নিয়ে, কারণ এসব স্বেচ্ছাসেবকরা স্থানীয় পর্যায়ে অধিভুক্ত এবং তার দলের সদস্য। তাদের কার্যক্রমের প্রশংসা শুনে বেশ খুশীই হলেন তিনি। মজা করে বললেন তার দলের ক্যাডাররা বরাবরই সামরিক বাহিনীকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে অভ্যস্ত। কিন্তু আমার মন তখন এসব রসিকতা বোঝার মতো অবস্থায় ছিল না। বরং মনে হচ্ছিল এতে জামায়াত এবং সেনাবাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতায় সীমাবদ্ধতা তৈরী হচ্ছে। বাস্তবে সেনাবাহিনী যেমন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়ছিল না, তেমনি এসব মুজাহিদরাও তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করছিল না। তারা জাতীয় স্বার্থেই পরস্পরকে সহযোগিতা করছিল, কেউ কারো উপকার করছিল না। তবে জামায়াতে ইসলামী এবং এসব উজ্জীবিত বাঙালী মুসলমানদের প্রশংসা করে বলতেই হয় যে তারা আমাদের সঙ্গে একদম শেষ পর্যন্ত লেগে ছিল।ইসলাম এবং পাকিস্তানের জন্য তারা মরতেও প্রস্তত ছিল কিন্তু দূর্ভাগ্য যে আমরা আত্মসমর্পন করে ফেললাম।]

এ ব্যাপারে সবচেয়ে চমকপ্রদ উদ্ধৃতিটি আসলে ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) সিদ্দিক সালিকের। উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে যুদ্ধবন্দী এই পাকিস্তানী সেনাকর্মকর্তা লিখেছেন: ‘In September 1971 a political delegation from erstwhile West Pakistan complained to General Niazi that he had raised an army comprising men nominated by Jamaat-e-Islami. …The general [Niazi] called me to his office and said: From now on, you will call the Razakars — Al-Badr and Al Shams — to give the impression that they do not belong to one single party.” [page; 105]
ভাবানুবাদ হচ্ছে:

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক প্রতিনিধিদলের সদস্যরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে অভিযোগ করে যে তিনি জামাতে ইসলামী মনোনীতদের নিয়ে একটি সামরিক বাহিনী গঠন করেছেন। জেনারেল আমাকে তার অফিসে ডেকে নির্দেশ দিলেন, এখন থেকে তুমি রাজাকারদের আল-বদর ও আল শামস বলে অভিহিত করবে যাতে বোঝা যায় এরা কোনো একটি সুনির্দিষ্ট দলের সদস্য নয়। যে অভিযোগের উল্লেখ সিদ্দিক সালিক করেছেন সেটি মোটেও হালকা কিছু নয়।

সালিক যা বলেছেন সেই অভিযোগ এসেছিলো পিপলস পার্টির তরফে। সেবার পূর্ব পাকিস্তান সফর করে এসে মাহমুদ আলি কাসুরি অভিযোগ করেন জামাতে ইসলামী ক্যাডাররা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিশ্চিহ্ন করার কাজে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করছে। এ ব্যাপারে পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ডানপন্থী রাজাকাররা বামপন্থীদের হত্যা করছে।’ এর প্রতিবাদ করেন মুসলিম লীগ (কাইয়ুম)প্রধান খান কাইয়ুম খান। ৬ সেপ্টেম্বর ‘অপবাদ মূলত সামরিক সরকারকেই দেওয়া হচ্ছে’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘যে রেজাকারদের সর্বদলীয় শান্তি কমিটির সহযোগিতায় সামরিক সরকারই বাছাই করেছেন এবং ট্রেনিং দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগিয়েছেন, তারা কি করে দল বিশেষের পক্ষ হয়ে অন্যান্য দলের কর্মীদের খতম করেছে তা ভাবতেই অবাক লাগে। অপবাদ কি মূলত সামরিক সরকারকেই দেওয়া হচ্ছে না?’

অক্টোবরে এই বিতর্ক আবার শুরু হয়। ১১ অক্টোবর বার্তা সংস্থা রয়টার্স সংবাদ পরিবেশন করে ‘PEOPLE’S PARTY LEADER ADMITS RAZAKAR TERROR’ শিরোনামে, যেখানে লেখা হয়: A leading People’s Party official dropped out of a party delegation hours before it left for East Bengal, alleging that power in the eastern wing had been handed over to reactionary and anti-people parties who had massacred political opponents. Meiraj Mohammed Khan, the party’s Karachi secretary, said yesterday (October 10) that he felt it was “futile for me to go”.
The 10-man party delegation was scheduled to go to Dacca to survey the situation in view of forthcoming by-elections for 78 seats formerly held by mem¬bers of the Awami League.
Meiraj alleged that in East Bengal “power in effect has been transferred to those reactionary and anti-people political parties defeated in the elections and rejected by the people”.
He named one party-the Muslim Jammaat-e-Islami group-of indulging in wholesale massacre of political opponents for which they are using their Razakars.

এমন নয় যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানেই এনিয়ে বিতর্ক উঠেছিলো। জামাতে ইসলামী যে রাজাকারদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে সে অভিযোগ উঠেছিলো জামাতের রাজনৈতিক সহযোগী দলগুলোর মধ্যেও। তার প্রমাণ মেলে পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক গোয়েন্দা নথিতে। ৩ অক্টোবর নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) নির্বাহী কমিটির এক জরুরী সভায় পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা ও নৈরাজ্যের জন্য জামাতে ইসলামী এবং রাজাকারদের দায়ী করে বক্তৃতা দেয় কজন নেতা। মজার ব্যাপার হচ্ছে রাজাকারদের নিয়ে পিপিপির ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি আর নুরুল আমিনের প্রশংসা নিয়ে ১৩ নভেম্বর একটি সংবাদ ছাপে হামিদুল হক চৌধুরী সম্পাদিত পাকিস্তান অবজারভার। লাহোর থেকে তাদের বিশেষ সংবাদদাতার পাঠানো ‘Row over Razakars: PPP’s Mysterious Seats’খবরটি মোটামুটি জামাতের লাইনে পরিবেশিত এবং পিপিপিকে একহাত দেখে নেওয়া হয়েছে।

রাজাকারদের সবচেয়ে দূর্ধর্ষ অংশ আল-বদরের সঙ্গে বর্তমান জামাত নেতৃত্বের সম্পর্ক কি? এ প্রসঙ্গে সে সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতৃত্বের তালিকাটা তুলে ধরা জরুরী যারা বাই ডিফল্ট আল বদরেরও শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলো । তালিকায় চোখ বোলালেই বোঝা যায় এই লোকগুলোই এখন জামাতে ইসলামীর বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত। তাই চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তাদের গ্রেফতার এবং কাঠগড়ায় ওঠানোটা যদি জামাতের শীর্ষ নেতৃত্বকে রাজনৈতিক হেনস্থা বোঝায়, সেটা হবে আরেকটি বড় মিথ্যাচার। বরং এটিই হচ্ছে ঘটনার পর্যায়ক্রমে বাধ্যতামূলকভাবেই প্রত্যাশিত এক প্রক্রিয়ামাত্র। বন্ধু ফখরুল আরেফীন একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন ‘আল-বদর’ নামে যা বর্তমান ট্রাইবুনালে অন্যতম প্রামান্য উপাত্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তার কয়েকটি ফুটেজ এই পোস্টে আমি ব্যবহার করেছি। এর একটি আল-বদর ও জামাত নেতৃত্বের সম্পর্ক নিয়ে যাতে স্পষ্ট এতে আলী আহসান মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামীদের সংশ্লিষ্টতা। প্রখ্যাত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির কনভেনর ডা.এম এ হাসান,সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব কামালের মুখে শোনা যাক:

এবার আসা যাক এ সংক্রান্ত সবচেয়ে অথেনটিক উপাত্তটিতে। ১৯৭১ সালে এই ছাত্র সংঘের সদস্যদের আল-বদর নামের খুনে বাহিনীতে রিক্রুট করার দায়িত্ব ছিলো আইএসআইর মেজর রিয়াজ হুসেইন মালিকের ওপর। বলা হয়, আল-বদর নামটাও তারই দেওয়া। উইকিপিডিয়াতে লেখা হয়েছিলো (অতীতবাচ্যে বললাম কারণ আমার একটা পোস্টে এই উদ্ধৃতিটা ব্যবহার করার পর দেখা গেছে লেখাটা এডিট করে সেখানে বসানো হয়েছে যে যদিও জামাতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন হিসেবে আল বদরদের অভিযুক্ত করা হয়, কিন্তু আসলে তাদের তেমন ট্রেনিং ছিলো না, অস্ত্রও ছিলো না। বরং এদের বেশীরভাগ ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিয়েছে। নাউজুবিল্লাহ!) : The name Al-Badar was given by major Riaz hussain during the passing out ceremony of first Al-badar group. ১৯৯৭ সালে পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে উর্দূতে একটা প্রামান্য চিত্র তৈরি হয় ‘জমিয়াত কি পঞ্চাশ সাল’ নামে। সেই বিশাল প্রামান্যচিত্রে পূর্বপাকিস্তানের ইসলামী জমিয়াতে তালাবা সম্পর্কে রিয়াজ হুসেইনের প্রশংসাধন্য বয়ান মিলে। প্রামান্য চিত্রটির একটা সংক্ষিপ্ত ভার্সন আছে ইউটিউবে। ‘আল-বদর ১৯৭১’ নামে ওই ফুটেজটি পাকিস্তানীদেরই আপলোড করা। সেখানে ভূমিকায় সমাজতান্ত্রিক ও সেক্যুলার ছাত্রদের (ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন) মোকাবেলায় যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে আইজেটিকেই মানা হয়। এবং এসব প্রগতিশীল ছাত্ররা যখন মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে সক্রিয়, তখন তাদের ঠেকাতে ছাত্রসংঘের বন্দুক ধরাও ফরজ বিবেচিত হয়েছে। রিয়াজ হুসেইন উর্দুতে কয়েকটা ঘটনার বর্ননা দিয়া এদের মাহাত্ম প্রচার করেছে এবং শুরুতেই উল্লেখ করেছে ইসলামী ছাত্রসংঘের নাম, তাদের ইসলাম প্রেম ও পাকিস্তান প্রেম। বিভিন্ন কাহিনীর মধ্যে রয়েছে একজন ছাত্রসংঘ সদস্য নাকি তার আপন ভাইকে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দিয়েছে সে মুক্তিবাহিনী এবং সুবাদে ভারতের দালাল বিধায়। তার যুক্তি এমন ভাইয়ের মরে যাওয়াই উচিত যে তার কোটি মুসলমান ভাইর সঙ্গে বেইমানি করছে! আরেকজন মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত ভাইয়ের জানাজা পড়েই (সে জানাজায় নাকি রিয়াজও ছিলো) আবার ডিউটিতে হাজির। এরকমই নানা গল্পের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের গুণ কীর্তন করা হয়েছে।

পাকিস্তানের জমিয়াতে তালাবার ওয়েবসাইটেও রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগঠনটির বীরত্বের কথা। তখনকার গোটা পাকিস্তানের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সম্পর্কে সেখানে লেখা হয়েছে: Motiur Rahman Nizam is the current chief (Ameer) of the Jamaat-e-Islami Bangladesh, which is the largest Islamic political party in Bangladesh. Nizami rose in the ranks of the Jamaat-e-Islami in East Pakistan in the 1960s, after being a leader of a student organization, Islamic Chhatro Shango (now Islami Chhatro Shibir). During the liberation war of 1971, Nizami actively supported the cause of West Pakistan and formed the Al-Badr Force in which he acted as the supreme commander of the Al-Badr Militia.

সেখানে উল্লেখ রয়েছে গোলাম আযমেরও।এবং আমরা যেটাকে তার অপরাধ হিসেবে গন্য করি তাই লেখা হয়েছে তার প্রশংসাসূচক বয়ানে: (Prof.Ghulam Azam ) (Born 7 November 1922) He is a Bangladeshi political leader who is regarded in his country as a war criminal of the Liberation War of Bangladesh. The former Ameer of Jamaat-e-Islami Bangladesh, he opposed the independence of Bangladesh during and after the 1971 war and led the formation of Shanti Committee, Razakar and Al-Badr to thwart the Mukti Bahini that fought for independence. He also lobbied against the acknowledgment of new-born Bangladesh after 1971 with a opened demand called ‘Bangladesh Na Manjoor’ (Bangladesh not approved). During this activity Ghulam Azam sent requests to Middle Eastern countries to deny recognition to Bangladesh. This continued until the late 1980s.

বর্তমান ইসলামী ছাত্র শিবিরের সঙ্গে তাদের পাকিস্তানী মূল সংগঠনের এখনও যোগাযোগের উল্লেখ নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে অন্য পোস্টে। 

আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ মানা যেতে পারে ইসলামী ছাত্রসংঘের সাবেক সদস্য এবং ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মিসবাহউর রহমান চৌধুরীর মতিউর রহমান নিজামীকে অভিযুক্ত করে দেওয়া বক্তব্য এবং আল-বদর গঠন সংক্রান্ত ছাত্রসংঘের একটি নির্দেশনামাকে।এক টিভিসাক্ষাতকারে মিসবাহ সে সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদরদপ্তর থেকে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে পাঠানো একটি চিঠি তুলে ধরেছেন যেখানে লেখা হয়েছে:
‘আগামী ১০ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্র সংঘের সকল নেতাকর্মীকে আল-বদর বাহিনীতে যোগদানের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হইয়াছে। ১০ আগস্ট আপনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মৌলভীবাজার কমান্ডের অফিসে সকাল ১০টার মধ্যে মেজর ফখরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাত করিয়া যোগদানপত্র গ্রহণ করিবেন।’

আল-বদরদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি আমাদের বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ডের। পাকিস্তান বাহিনীর সমান্তরালে জামাতে ইসলামী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ক্যাডাররা আল-বদর নামে এই জঘন্য গণহত্যাটি শুরু করেছিলো অক্টোবর থেকে যা তীব্রতা পায় ডিসেম্বরে এবং চলে আমাদের স্বাধীনতার আগেরদিন পর্যন্ত। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েই শহীদ বুদ্ধিজীবিদের স্বজনরা মামলা করেছেন এবং অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযুক্তরা কেউই পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা নয়, সবই আল-বদরের সদস্য যাদের তারা সরাসরি চিহ্নিত করেছেন বুদ্ধিজীবিদের অপহরণের সময়। নীচের ভিডিও ফুটেজটিতে নিহত বুদ্ধিজীবিদের কয়েকজন স্বজন জানাচ্ছেন তাদের এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা:

এ প্রসঙ্গে ব্রিটেনে পালিয়ে থাকা কুখ্যাত তিন যুদ্ধাপরাধী নিয়ে চ্যানেল ফোর নির্মিত ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ তথ্যচিত্রটি থেকে কিছু ফুটেজ ব্যবহার করা যায়। প্রফেসর আনিসুজ্জামান বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডে আল-বদরদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে বলেছেন:

বুদ্ধিজীবি নাজমুল হকের অপহরণ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন সেসময় হত্যা তালিকায় থাকা এবং ঘটনার সময় পাশের বাড়িতে লুকিয়ে থাকা বিবিসির সাবেক সাংবাদিক আতাউস সামাদ। সেইসঙ্গে তার ভাড়াটে মোশতাকুর রহমান এবং মাহমুদুর রহমান বলেছেন আতাউস সামাদের খোজে আসা আল-বদরদের সম্পর্কে। ফুটেজটিতে আরো রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবি সিরাজুদ্দিন হোসেনের স্ত্রী নুরজাহান সিরাজীর বক্তব্য:

বুদ্ধিজীবিদের ধরে নিয়ে রাখা হতো মোহাম্মদপুর ফিজিকাল ট্রেনিং সেন্টারে। এটা ছিলো আল-বদর সদর দপ্তর। গুলি করে মারার আগে নৃশংস অত্যাচার করা হতো তাদের ওপর । ‘৭১ সালে ওই ট্রেনিং সেন্টারের দারোয়ান রহম আলী জানিয়েছেন তার অভিজ্ঞতা:

আল-বদরদের নৃশংসতার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী মোহন মুন্সীও ক্যাম্পের দ্বাররক্ষক ছিলেন। শেরপুরের আল বদরদের নৃশংসতা এবং বতর্মান জামাত নেতা কামারুজ্জামান সম্পর্কে এরকমই বর্ণনা উঠে এসেছে তার এবং নিহতদের স্বজনদের মুখেও:

সেই খুনীদের হাত থেকে পালিয়ে আসার ভাগ্য খুব অল্প ক’জনের হয়েছে। তাদের একজন ঢাকার গ্রিনল্যান্ড মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চিফ একাউনটেন্ট মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। এখন পর্যন্ত খোঁজ মেলা অল্প ক’জন ভাগ্যবানের তিনি একজন যিনি আল-বদরদের হাত থেকে পালাতে পেরেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়েছিলো ‘বধ্যভূমির অভিজ্ঞতা’ শিরোনামে তার সেই বন্দীজীবন ও মৃত্যুর মুখ থেকে পালানোর কাহিনী ।

সারা দেশজুড়ে জামাত ও আলবদরদের নৃশংসতার নানারকম সাক্ষ্যই মিলেছে। শুধু হত্যাতালিকা তৈরী নয়, সিলেটের চা-বাগানে আল-বদররা গণধর্ষনেও যুক্ত ছিলো বলে প্রমাণ মিলেছে চ্যানেল ফোরের প্রামান্যচিত্রে। স্বাধীনতার পর সিলেটের বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করা সৈয়দা জেবুন্নেসা হক জানাচ্ছেন সেপ্টেম্বরে সংঘটিত এমন এক নৃশংসতার কথা:

বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ডে উস্কানী দিয়ে গোলাম আযাম ও জামাতের মুখপাত্র সংগ্রামের প্রচুর উপসম্পাদকীয় ও বিবৃতির খোজ মেলে। তার কয়েকটি তুলে ধরা যাক। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে ‘সম্পাদক সমীপেষু’ কলামে আব্দুল বারী নামে এক আলবদর কমান্ডারের এই চিঠিটি ছাপা হয় :

জনাব,
স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আলবদর বাহিনীর নাম আজ প্রদেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে পৌঁছে গেছে। গত ২৭ জুন জামালপুর মহকুমায় আলবদর বাহিনী গঠিত হবার পর আজ সমগ্র মোমেনশাহী জেলা ও প্রদেশের আরো দুয়েকটি জেলায় এর কাজ শুরু হয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আলবদর বাহিনী পাকিস্তানবাদী ইসলামপন্থী দেশপ্রেমিক ছাত্রদের দ্বারা গঠিত। এতে ইস্কুলের ১২ বছরের ছেলে থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র রয়েছে।
যতদূর জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে জামালপুর মহকুমাতেই পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। এখানে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ৪০% থেকে ৫০% ছেলে পরীক্ষা দিয়েছে। জামালপুর মহকুমার শেরপুর, নলিতাবাড়ি, ইসলামপুর, দেওয়ান গঞ্জ ও জামালপুর শহরে দুষ্কৃতিকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে।
জামালপুরের বিভিন্ন জায়গায় সীমান্তবর্তী এলাকায় আলবদর বাহিনী সাহসিকতা ও সাফল্যের সঙ্গে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের মোকাবেলা করেছে। আলবদর বাহিনীর তৎপরতা দেখে ভারতীয় অনুচর নাপাক বাহিনীর লোকেরা জামালপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে বলে ক্রমাগত সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আলবদর বাহিনীর বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রতিটি ছেলেই শিক্ষিত এবং নামাজ পড়ে। ধনসম্পদ ও নারীর প্রতি কোনো লোভ নেই। বদর বাহিনীর গত তিনমাসের কাজে কোনো চারিত্রিক দূর্বলতা দেখা যায়নি। এজন্যই জনগণের কাছে আশার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের প্রিয় নাম আলবদর। জামালপুরে রেজাকার, পুলিশ, মুজাহিদ ও রেঞ্জাররা পুল ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পাহারা দিচ্ছে আর পাক ফৌজ ও আলবদর বাহিনী অপারেশন করছে।
আমি পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক ইসলামপন্থী ছাত্রজনতার কাছে আহবান জানাচ্ছি সামরিক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ও সাহায্য নিয়ে দ্রুত প্রদেশের সর্বত্র আলবদর বাহিনী গঠন করতে। বদর বাহিনী ছাড়া শুধু রেজাকার ও পুলিশ দিয়ে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি আয়ত্বে আনা সম্ভব নয়। আমাদের কাছে রেজাকার, বদর বাহিনী ও মুজাহিদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমরা সবাইকে মনে করি সমান। ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও তার দালালদের শায়েস্তা করতে আজ তাই প্রদেশের সর্বত্র আলবদর বাহিনী গঠন করা প্রয়োজন।
দেশের বর্তমান নাজুক ও সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে যত তাড়াতাড়ি আলবদর বাহিনী প্রদেশের সর্বত্র গঠিত হয় ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল। আল্লাহ আমাদের তার পথে কাজ করা তৌফিক দান করুন। আমিন।

মোহাম্মদ আব্দুল বারী
ইনচার্জ, আলবদর ক্যাম্প, ইসলামপুর থানা, মোমেনশাহী
ও প্রচার সম্পাদক, জামালপুর মহকুমা শান্তি কমিটি

স্বাধীনতার পর এই আব্দুল বারীর ব্যক্তিগত ডায়েরিটি উদ্ধার করা হয়। সেখানে মিলে চিঠির সঙ্গে বদরদের চারিত্রিক গুণাবলীর অসঙ্গতির চিত্র। ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে মুদ্রিত ডায়েরির প্রধান বিবরণগুলি হচ্ছে :

টাঙ্গাইলে successful operation হয়েছে। হাজার দেড়েকের মতো মুক্তিফৌজ মারা পড়েছে আলবদর ও আর্মির হাতে।
1.Haidar Ali 2. Nazmul Haque. Rs 2500.00

তিতপল্লার শিমকুড়া গ্রাম- জব্বারের কাছে ২৯/১০/৭১ আর তিন হাজার নেওয়ার পরিকল্পনা আছে
24-10-71… … Prostitution Quarter
26-10-71… Raping Case… Hindu Girl

আল-বদরদের একদম স্পেসিফিক মিশনই ছিলো দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা। এটি যত না পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তার চেয়েও বেশী ছিলো জামাতে ইসলামীর নিজস্ব এজেন্ডা। কারণ যেসব মিথ্যাকে অবলম্বন করে তারা রাজনীতি করে তার মুখোশটা সহজেই খুলে দেওয়ার ক্ষমতা এই বুদ্ধিজীবিরা রাখতেন। দেশের জনগনের একটা বড় অংশই অশিক্ষিত বলে এদের ধর্মের দোহাই দিয়ে বশে রাখা যায়, শিক্ষিতদের সেটা সম্ভব নয়। জামাত-শিবির মিথ্যা অপপ্রচার এবং ঘটনা বিকৃত করে নিজের ফায়দায় কাজে লাগানোর যে চর্চায় অভ্যস্ত যুগ যুগ ধরে তা বজায় রাখতে এদের নিশ্চিহ্ন করাটা তাই জরুরী ছিলো। আগেই বলেছি এ ব্যাপারে অজস্র এবং অসংখ্যবার উস্কানী এসেছে গোলাম আযমসহ জামাতের বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। এ প্রসঙ্গে নীচে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত কিছু সংবাদ ও সম্পাদকীয়র অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো। তাতেই পাঠক প্রমাণ পাবেন গোলাম আযম, জামাতের শীর্ষ নেতৃত্ব কোনোভাবেই রাজাকার এবং আল-বদরদের সংগঠিত এবং ব্যবহার করে এসব হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। এবং যুদ্ধাপরাধ আদালতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো অভিযুক্তের উপস্থিতি ছাড়াই স্রেফ এই একটি সুনির্দিষ্ট গণহত্যার অপরাধেই তাদের প্রত্যেকের শাস্তি হতে পারে।

২ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম এক সম্পাদকীয়তে গোলাম আযমের সুপারিশ মেনে বেসামরিক পাকিস্তানপন্থীদের সশস্ত্র করার জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানায়। সে লেখায় মওলানা আবদুর রহিমের বরাতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রোপোগান্ডা চালানোর জন্য বিভিন্ন সরকারী অফিসের কর্মচারীদের অভিযুক্ত করা হয়:

 

১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবাষিকীতে কার্জন হলে ইসলামী ছাত্র সংঘের এক অনুষ্ঠানে আল-বদরদের আগমনী উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা বার্তা শোনা যায় গোলামের কণ্ঠে:

১৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রামে গোলামের একটি সাক্ষাতকারে দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হয়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বরং তাদের প্রতি সহমর্মীদের সমাজের বিভিন্ন অবস্থান থেকে খুজে বের করার নির্দেশ দেয়:

১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরে আলবদর হেডকোয়ার্টার সফর করে গোলাম এবং সেখানে তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেয়। বক্তৃতায় সেনাবাহিনীর কাজের সুবিধার্থে ঘরের শত্রু অর্থাৎ স্বাধীনতাকামীদের খুজে বের করে হত্যার নির্দেশ দেয় সে:

২৩ সেপ্টেম্বর মতিউর রহমান নিজামী কোনো রাখঢাক না করেই সুস্পষ্ট অভিযোগের আঙুল তোলে বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে। ইসলামিক একাডেমিতে আয়োজিত সিরাত সম্মেলনে গোলাম আযমের উপস্থিতিতে পাকিস্তান ছাত্রসংঘ প্রধান বলে, যারা ইসলামকে ভালোবাসে, শুধু মাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালোবাসে। এবারের উদঘাটিত এই সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবিরা ভুলে যেতে না পারেন, সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

দলীয় কর্মীদের স্ট্যাটাস বাকিদের চেয়ে উচুতে রাখতেই ৭ নভেম্বর সংগ্রাম তাদের সম্পাদকীয়তে লেখে যে সেনাবাহিনীর পরই রাজাকারদের অবস্থান:

১০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভারতের দালাল ও বিশ্বাসঘাতকদের খুজে বের করে হত্যা করার যুক্তি দেয় দৈনিক সংগ্রাম ‘বাবুদের আরেক রূপ’ শিরোনামে:

১২ নভেম্বর ‘রোকেয়া হলের ঘটনা’ শিরোনামে এক উপসম্পাদকীয়তে আবারও অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা সন্দেহজনকদের খুজে বের করে হত্যার কথা বলে সংগ্রাম:

১৪ নভেম্বর মতিউর রহমান নিজামির লেখা ‘পাকিস্তান ও আল বদর’ নামে একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সংগ্রামে। সেখানে নিজামী লেখে:

… আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকসেনার সহযোগিতায় এ এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্র সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল তিনশত তের। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যোদ্ধাদের সেইসব গুণাবলীর কথা আমরা আলোচনা করেছি, আলবদর তরুণ মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাল্লাহ সেই সর্বগুণাবলী আমরা দেখতে পাব।

পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গঠিত আলবদরের যুবকেরা এবারে বদর দিবসে নতুন করে শপথ নিয়েছে, তাদের তেজোদ্দীপ্ত কর্মীদের তৎপরতার ফলেই বদর দিবসের কর্মসূচী দেশবাসী তথা দুনিয়ার মুসলমানদের সামনে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে। ইনশাল্লাহ, বদর যুদ্ধের বাস্তব স্মৃতিও তারা তুলে ধরতে সক্ষম। তরুণ যুবকরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে।’

একই সংখ্যায় আলী আহসান মুজাহিদ লেখে ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র, যুক্ত নয় নামে একটি প্রবন্ধ। ২৩ নভেম্বর সারাদেশে জরুরী অবস্থা জারী করে ইয়াহিয়া সরকার। এ সময়ই মাঠে নামে আল-বদর। এর আগে তারা তাদের টার্গেট বুদ্ধিজীবিদের একটি চিঠি পাঠায়। শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেনের পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠিতে লেখা ছিলো:

শয়তান,
ব্রাক্ষণ্যবাদী হিন্দুদের যেসব পা চাটা কুকুর আর ভারতীয় ইন্দিরাবাদের দালাল নানা ছুতানাতায় মুসলমানদের বৃহত্তম আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তুমি তাদের অন্যতম। তোমার মনোভাব, চালচলন ও কাজকর্ম কোনোটাই আমাদের অজানা নেই। অবিলম্বে হুশিয়ার হও এবং ভারতের পদলেহন থেকে বিরত হও, না হয় তোমার নিস্তার নেই। এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।
শনি

১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা হত্যাকান্ডের অপারেশন ইন চার্জ ছিলো চৌধুরী মঈনউদ্দিন , যে এখন ইংল্যান্ডে বসে বিরাট ধর্মীয় নেতা বনে গেছে। আর মূল ঘাতকের ভূমিকায় ছিলো আশরাফুজ্জামান , যে এখন নিউইয়র্কে এক মসজিদে ইমামতি করছে। স্বাধীনতার পর মোস্ট ওয়ান্টেড এই দুজন এখন ইসলাম বিক্রি করে খাচ্ছে বিদেশে। এবং জামাতে ইসলামীর নেতা হিসেবেই।

আল-বদরদের মাটিলেপা মাইক্রোর (যেটি করে তারা বুদ্ধিজীবিদের তুলে নিয়ে আসতো) ড্রাইভারের স্বীকারোক্তিতে জানা যায় ইসলামী ছাত্র সংঘের হাই কমান্ডের কার কি ভূমিকা। ক’দিন পর ধরা পড়া জামাতের প্রচার সম্পাদক (বর্তমানে আধুনিক প্রকাশনীর দায়িত্বে এবং বাংলাদেশের বেশ ক’জন উঠতি বুদ্ধিজীবির দেখাশোনা করে) আবদুল খালেক তার জবানবন্দীতে স্বীকার করে ইসলামী ছাত্র সংঘের এই ভয়াবহ নীলনক্সা।

এতো নৃশংস নির্মমতার সঙ্গে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়েছে যে অনেকের লাশের হদিসও মেলেনি। আজ, এই চল্লিশ বছর বুকে পাথর বেধে রাখা শহীদের স্বজনরা সেই হত্যাকান্ডের বিচারের উপলক্ষ্য পেয়েছে। তা ভন্ডুলের চেষ্টা চলবে, কিন্তু অস্বীকার করার প্রবণতা আমরা রুখে দেবো। মাথায় টুপি পড়ে, হাতে কোরান নিয়ে যারা গণহত্যায় নামতে পারে, তারা মুসলমান নয়, মোনাফেক। এরা মিথ্যেবাদী প্রতারক। এদের রেহাই আল্লাহ এই দুনিয়াতেও দেননি।