একাত্তরের ঈদ : মুক্তিযুদ্ধের এক টার্নিং পয়েন্ট

একাত্তরের ঈদ : মুক্তিযুদ্ধের এক টার্নিং পয়েন্ট

(নাহ সেমাই বা পোলাও সেদিন কিছুই রান্না হয়নি আমাদের। সরাইলে বাবার এক সহকর্মীর বাসায় আশ্রিত হয়ে ছিলাম আমরা কয়েকটি পরিবার। কর্তারা ২৭ রমজানের ইফতার পার্টির নামে মৃত্যুফাঁদ ফাকি দিতে পেরেছেন। ভাগ্যক্রমে সামিল হননি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কুরুলিয়া খালের পাশে লাইন ধরে গুলি করে মারা আমন্ত্রিত বুদ্ধিজীবিদের কাতারে। পরদিন সকালেই আমার ডাক্তার বাবা সপরিবারে পালালেন বাকিদের নিয়ে। প্রসঙ্গত সিরু মিয়াকে নিয়ে লেখা আগে একটি পোস্টে আমি একাত্তরের ঈদের হিসেব পেয়েছিলাম ২৩ নভেম্বর। সেটি ভুল ছিলো। যেমন ভুল ছিলো তার মৃত্যুদিনটি। যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়েছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে একাত্তরের পবিত্র ঈদের দিন হত্যা করা হয়। আর দিনটি ছিলো ২০ নভেম্বর। নানা আর্কাইভ ও বইপত্র ঘেটে এই দিনটি নিয়ে চমকপ্রদ সব তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এটি ছিলো আমাদের স্বাধীনতার ডি-ডে। এদিনই গোটা বাংলাদেশ জুড়ে ব্যাপক মাত্রায় হামলা শুরু করে মুক্তি বাহিনী, ব্যাপক গতি পায় মুক্তিযুদ্ধ। ঠিক ২৬ দিন পরে আসে আমাদের স্বাধীনতা। বিচ্ছিন্ন এই ঘটনাগুলো একাট্টা করলাম আমার ব্লগের ব্লগারদের জন্য। ঈদের শুভেচ্ছা। )
আজ ঈদ। ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামাকাপড় কেনা হয়নি। দরজা জানালার পর্দা কাচা হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ, জামি ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। কিন্তু আমি খুব ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়ীতে? তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য একশিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি। (একাত্তরের দিনগুলি : জাহানারা ইমাম)

২০ নভেম্বর শনিবার দিনটি কোনো মুক্তিযোদ্ধার মায়েরই অন্যরকম কাটেনি। ছেলে বেঁচে আছে না মরে গেছে, কি খাচ্ছে না খাচ্ছে- এই আকুলতায় আগের সারাটি রাত ছটফট করেছেন তারা। স্বামীর সঙ্গে হয়তো গল্প করেছেন আগের ঈদগুলোতে তার বায়নাক্কা নিয়ে। অনেক যত্নে তুলে রাখা গুড়, দুধ কিংবা চিনি দিয়ে রেধেছেন সেমাই বা পায়েস। সাধ্যে কুলোলে পোলাও। যদি ছেলে আসে! যদি আসে! নাহ, তাদের সন্তানদের সময় ছিলো না মায়েদের ইচ্ছে পূরণের। তারা তখন তুমুল প্রত্যয়ে লড়াইয়ে, বিজয় ঘনিয়ে এলো বলে। বেঁচে থাকলে স্বাধীন বাংলাদেশে ঈদ করবেন তারা। 
এতো গেলো মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। সাধারণ মানুষের জন্য কেমন ছিলো একাত্তরের ঈদ। আগের বছর প্রলয়ঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড়ে নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিলো বাঙালীর ঈদ। সেবছরও তার ব্যত্যয় হয়নি। শহরে ন্যাড়া মাথায় লাল ফেট্টি বাঁধা বিহারী ও তাদের বাঙালী স্যাঙ্গাতরা ছাড়া কারো মধ্যে উৎসবের আমেজ ছিলো না। দীর্ঘ অনাহারে কিংবা খেয়ে না খেয়ে থাকা লাখো উদ্বাস্তুর কাছে রমজান ছিলো অনিশ্চয়তাময় নতুন একটা মাস মাত্র। এর কোনো আলাদা ধর্মীয় তাৎপর্য তারা ধারণ করতে অক্ষম ছিলেন। নভেম্বরের শুরুতে সারা দেশজুড়ে শুরু হয় কলেরার প্রকোপ। বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, ঢাকা, নরসিংদী, সিলেট, ফরিদপুর, যশোরসহ দেশের একটা বড় অংশের মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়েন। এই মহামারী ঠেকানোর বদলে উল্টো এর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। সরকারী প্রেসনোটে বলা হয়, ‘পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা সত্বেও দূস্কৃতিকারীদের কারণে চিকিৎসা কর্মীরা আক্রান্ত এলাকায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছে না।’ 
এদিকে রোজার শুরুতেই মাঠে নেমে গেছে জামাতে ইসলামীর খুনে বাহিনী আল-বদর। প্রতিদিন তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। কারো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। দেশ জুড়ে জিহাদের ধোঁয়া তোলা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলো বলে। ১০ নভেম্বর লাহোরে এক সম্বর্ধনায় গোলাম আযমের বক্তৃতায় তার আঁচ, ‘পাকিস্তানের জনগন জেহাদী মনোভাব নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে আমরা দিল্লী ও কলকাতায় গিয়ে ঈদের নামাজ পড়বো।’ ১৬ তারিখ গভর্ণর ডাঃ মালিক মন্ত্রীপরিষদের বৈঠকে ঘোষনা দিয়েছেন নতুন একটি ঘাতক বাহিনী গঠনের যার নাম হবে ‘শান্তি সেনা’। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করা হচ্ছে। শবে কদরের রাতে নামাজের জন্য ঘণ্টাখানেক তোলা হলেও ফজরের আজানের আগেই আবার তা জারি করা হয়। সেদিন ঢাকায় দুষ্কৃতিকারী হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হয় ১৩৮ জন নিরীহ মানুষকে। তবে গোটা রমজান জুড়েই ঢাকা শহরে তাদের সরব উপস্থিতির জানান দিয়ে গেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। মায়া ক্র্যাক প্লাটুন উড়িয়ে দিয়েছে বেশ কিছু পেট্রলপাম্প, পাওয়ার স্টেশন। ঈদের আগের দিন রামপুরা এলাকায় মর্টার হামলা চালায় তারা। টিভি সেন্টারের কাছে গুলি করে হত্যা করা হয় একজন জামাত নেতাকে। ঈদের দিন মুক্তিযোদ্ধাদের হামলার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো আগেই। সুবাদেই ১৮ নভেম্বর সবকটি পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রেসনোট আসে। বলা হয়, ‘ঈদ উৎসব বিশেষ করে ঈদের জামাতে গন্ডগোল করবে বলে দুষ্কৃতিকারীরা প্রচারণা ও গুজব ছড়িয়েছে। এদিন যে কোনো ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা দৃঢ় হাতে দমন করা হবে। কোনো সন্ত্রাস বা গন্ডগোল হতে দেওয়া হবে না।’ বাস্তবে সে ক্ষমতা তাদের ছিলো না। শান্তিনগরে তাদের নাকের ডগাতেই কেন্দ্রীয় চলচিত্র দফতরে ঈদের দিন বোমা হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে মুক্তিযোদ্ধারা । 

এবং অমূলক ছিলো না তাদের আশঙ্কা। নভেম্বরের শুরুতেই ইয়াহিয়া খান বুঝে যান পাকিস্তানের ঐক্য টেকাতে হলে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার বিকল্প নেই। লড়াইটা শুরু করা গেলে আন্তর্জাতিক চাপ আসবে। সে মাসের শুরুতেই চীন সফর করে সবধরণের সামরিক সহায়তার আশ্বাস নিয়ে এসেছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এজন্য রাজাকার-আলবদর-ইস্টপাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেসের মতো আধাসামরিকদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা ঠেকানোর দায়িত্ব দিয়ে সেনাবাহিনীর বড় অংশকেই সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে সন্নিবেশ করতে থাকে পাকিস্তান।

পিছিয়ে ছিলো না ভারতও। আগস্টেই ‘অপারেশন ক্যাকটাস লিলি’ শুরু করে তারা। এটি ছিলো মূলত পরীক্ষামূলক আক্রমণ। প্রতিক্রিয়া বিচার করেই বড় ধরণের সামরিক অভিযানের জন্য পরিকল্পনা নতুন করে সাজায় তারা। ঈদের দিন থেকেই যে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করা শুরু করে তার উল্লেখ এসেছে বিভিন্ন লেখনীতে। এদের একজন ৩১ পাঞ্জাবের কমান্ডিং অফিসার মেজর মুমতাজ হোসেইন শাহ পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে সিলেটের যুদ্ধ নিয়ে একটা স্মৃতিকথা লিখেছেন। সেখানে অবশ্য ২১ নভেম্বরকে ঈদের দিন বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তার ভাষ্যে It was 21st November, the Eid-ul-Fitr was being celebrated throughout the Muslim world with religious fervour. We had barely finished our Eid prayers, when my forward positions reported Indians concentration, requesting for artillery fire. The artillery duel commenced and continued till afternoon.

পরিকল্পনা মতোই ঈদের দিন মুক্তিযোদ্ধারা দেশজুড়ে নতুন আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দলিলপত্রে দেখা যায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী বা মুক্তিফৌজ এদিন বসন্তপুর সীমান্ত চৌকির দখল নেয়। আর হিঙ্গলগঞ্জ থেকে ভারতীয় বাহিনী ইছামতি নদী অতিক্রম করে যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে, বসন্তপুর ও কালীগঞ্জকে মুক্ত করে। সাপ্তাহিক জয় বাংলা একজন বিদেশী সাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে : সাত মাস পাক বাহিনীর দখলে থাকার পর কালীগঞ্জ মুক্ত হয়। ১৯ নভেম্বর উকসার দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে মুক্তিবাহিনী। পাকিস্তানীর পিছু হটে অবস্থান নেয় ইছামতির পূর্ব পারে। সারারাত লড়াই চলে। শনিবার বেলা ১২টার দিকে কালীগঞ্জ থেকে পালায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা। এ ব্যাপারে আরো ডিটেলে জানিয়েছেন ৯ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধাদের একজন ওবায়দুর রহমান মোস্তফা। তার ভাষ্যমতে, কালীগঞ্জের ওয়াপদা কলোনীতে এক কোম্পানী পাকসেনার সঙ্গে পাকিস্তানী রেঞ্জার ও বেশ কিছু রাজাকার অবস্থান নিয়েছিলো। উকসা বিওপি ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা এটি আক্রমণ করতে রওয়ানা হন। এক কলাম যোদ্ধা নিয়ে বসন্তপুর হয়ে কালীগঞ্জ পৌছান তিনি। দু প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাছাকাছি অবস্থান নেন লে. আহসানউল্লাহ এবং নায়েক সুবেদার সোবহান। আরেক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে তাদের সঙ্গী হন নায়েক সুবেদার গফুর। ভোর পাচটায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ শুরু করে। হিঙ্গলগঞ্জ থেকে তাদের আর্টিলারি সাপোর্ট দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৃতীয় রাজপুত। দুঘণ্টার এই যুদ্ধ শেষে ৪০ জন পাকিস্তানী সেনা বন্দী হয়। 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনও এসময় পাক-ভারত যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ মাসের শুরুতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব সফরে বের হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালান। এক কোটি বাঙালী শরণার্থী সমস্যার সমাধান, শেখ মুজিবের মুক্তি ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে দেন দরবার শুরু করেন তিনি। সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রও। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দলিলপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে এসময় নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন তুমুল উদ্বেগে। কলকাতার মার্কিন দুতাবাস নিশ্চিত করেছে মুক্তিবাহিনী বড় ধরণের আক্রমণ যাচ্ছে। সিআইএ প্রতিবেদন বলছে ভারতীয় বাহিনী কোনো রাখঢাক ছাড়াই তাদের সঙ্গী হচ্ছে। বলা প্রয়োজন, ২৩ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনীর ঘোষণা আসে। তার আগে ২২ নভেম্বর কলকাতা থেকে এক জরুরী ডাকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লী যান প্রবাসী সরকারের প্রধান তাজউদ্দিন আহমদ সহ বাকীরা। ফেরেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিয়ে। ঈদের আগের সপ্তাহ পুরোটাই পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ব্যস্ত ছিলেন ইয়াহিয়া ও নিক্সনের মধ্যে দূতিয়ালীতে। পাক-ভারত সম্ভাব্য লড়াই নিয়ে সে সময় প্রায় প্রতিদিনই সভায় বসেছেন কিসিঞ্জার। ২৩ নভেম্বর ফারল্যান্ডকে পাঠানো এক টেলিগ্রামে মিত্রবাহিনীর আক্রমণে তীব্র উদ্বেগ জানায় যুক্তরাষ্ট্র। 

ফেরা যাক ঈদের দিনটিতে। এদিন উপলক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বাণী ছিলো, ‘দেশের জনগণের দুর্দমনীয় সাহস ও সেনাবাহিনীর জেহাদী শক্তি আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার কবচ।’ পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত সৈনিকদের জাতির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পাশাপাশি ভারতে উদ্বাস্তুদের দেশে ফেরার আহ্বান জানান। তাদের সব ধরণের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের আশ্বাস দেন তিনি। গভর্ণর মালিক তার বাণীতে বলেন, ‘ঈদের শিক্ষার মাধ্যমেই আমরা জাতীয় সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো। দেশরক্ষায় যুদ্ধরত যেসব সৈনিক তাদের পরিবার পরিজনদের সঙ্গে মিলিত হতে পারছেন না তাদের এই ত্যাগ জাতি চিরদিন স্মরণ করবে।’ পল্টন ময়দানে এদিন ঈদের জামাত পড়েন মালিক। সেখানে নামাজীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘এদেশের এক শ্রেণীর নেতারা জনগণকে বিপথে পরিচালনা করছে। জনগণের অধিকার আদায়ের নামে তারা জয় বাংলা ধ্বনি তুলছে, যা পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি ও অখন্ডতা বিপন্ন করে তুলছে।’ ঈদ উপলক্ষ্যে রাজাকারদের বেতন-ভাতা বাড়ার ঘোষণা আসে।পাকিস্তান অবজারভারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায় কোম্পানি কমান্ডারদের বেতন নির্ধারিত হয় রেশনসহ ২৫৫ রুপি, রেশনছাড়া ৩০০ রুপি। প্লাটুন কমান্ডারদের রেশনসহ ও ছাড়া যথাক্রমে ১৩৫ ও ১৮৫ রুপি। সাধারণ রাজাকারদের ক্ষেত্রে অঙ্কটা দাড়ায় ৭৫ ও ১২০ রুপি। 

ঈদের আগের দিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র সাপ্তাহিক জয় বাংলার ২৮তম সংখ্যা। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বাণী এই উপলক্ষ্যে বক্স আইটেম করে পত্রিকাটি। এই ঈদে আমাদের প্রার্থনা হোক এই শিরোনামে লেখা হয়, ‘আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলীকৃত এলাকায় শত্রুসৈন্যের তান্ডব চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন. মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভুমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে, আছে শুধু স্বজন হারানোর শোক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব। আমি আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি যে, যথাসর্বস্ব পণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলে যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়োগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হোক আমাদের প্রার্থনা। 

সম্পাদকীয় পাতায় বঙ্গবন্ধুর একটা বাণী ছিলো। এটার গুরুত্ব আমার কাছে যথেষ্টই প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। পাকিস্তানী কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে তখন সংশয়। ক্যামেরা ট্রায়ালে তার মৃত্যুদন্ড প্রায় নিশ্চিত। তার মুক্তির বিনিময়ে প্রয়োজনে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ- খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে এমন একটি ষড়যন্ত্র তখন ভেস্তে গেছে। মুজিব এবং স্বাধীনতা দুটোই চাই, এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে লড়ছেন তাজউদ্দীন ও মুক্তিযোদ্ধারা। তার উপর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নীতি ধর্ম নিরপেক্ষতা। গোলাম আযমের ব্যাখ্যা তথা জামাতে ইসলামীর যুগযুগের প্রচারণার মতো এটা যে ব্যক্তির ধর্মের সঙ্গে আদৌ সাংঘর্ষিক নয় তার একটি প্রামাণ্য হতে পারে বঙ্গবন্ধুর বাণীটি। ‘আমি নিজেকে বাঙালী ভাবতে গর্ব বোধ করি। বহতা নদীর মতো আমাদের সংস্কৃতির ধারাও বেগবতী ও প্রাণাবেগপূর্ণ। আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলে বাঙালী আবার বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াবে। বাঙালী হওয়ার সঙ্গে ধর্মে মুসলমান থাকার কোন বিরোধ নেই। একটি আমার ধর্ম। অন্যটি জাতি পরিচয়। ধর্ম আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচার। জাতি পরিচয় আমার সমষ্ঠিগত ঐতিহ্য। একজন হিন্দু বাঙালী ও মুসলমান বাঙালী অথবা বৌদ্ধ বা খৃষ্টান বাঙালীর মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে, তাদের ধর্মমত শুধু আলাদা। কিন্তু খাদ্য, রুচি, ভৌগলিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, বর্ণ ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিক থেকে তারা অভিন্ন। 

দারুণ লেগেছে সম্পাদকীয়টিও। উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ শিরোনামে এতে লেখা হয়েছে, …গতবার বাংলার মুসলমান বিশলাখ মানুষের মৃত্যুর শোকে রোজার ঈদে শোকাশ্রু চোখে কাতারবন্দী হয়েছে নামাজের ময়দানে, -এবার আরো দশ লাখ ভাইবোনের লাশের স্তুপের উপর বসে তারা আকাশে দেখছে বাঁকা খঞ্জরের মতো ঈদের চাঁদ। এবারও তারা উৎসব পালন করতে পারে না। আর রোজার ঈদ তো উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগ ও কৃচ্ছ সাধনার ঈদ। সারা বাংলার মানুষ আজ এই মহান ত্যাগব্রতে উদ্বুদ্ধ যে দেশকে হানাদার দস্যুদের কবলমুক্ত করার জন্য তারা হাসিমুখে প্রাণ কোরবান করবে। আজ নয়, বাংলার আকাশে খুশীর ঈদের চাঁদ একদিন উদিত হবে। এবং সেদিন সুদূর নয়-যেদিন ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হবে এবং স্বাধীন ও মুক্তবাংলার নীলাকাশে শওয়ালের চাঁদ সব অশ্রুর কুয়াশামুক্ত হয়ে আবার খুশীর রোশনাই ছড়াবে। 

মুক্তিযুদ্ধের ঈদ

এখানে উল্লেখযোগ্য যে ঈদ উপলক্ষ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাণীটি সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে সম্প্রচার করা হয়। জয় বাংলায় এটি ছাপা হয় ২৬ নভেম্বর সংখ্যায়। ‘আমরা বিজয়ের ঈদ-উৎসব পালন করবো’ শিরোনামে প্রকাশিত বাণীটিতে সৈয়দ নজরুলের বরাতে বলা হয়, পবিত্র রমজান মাসেও হানাদার বাহিনীর বর্বরতায় বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু নির্বিশেষে অসংখ্য নরনারী নিহত হচ্ছে। গত বছর আমরা বারোই নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে নিহত দশলাখ মানুষের শোকে মুহ্যমান অবস্থায় ঈদ উৎসব পালন করতে পারিনি। এবারও আমরা ইয়াহিয়ার সৈন্যদের বর্বরতায় নিহত দশ লাখ ভাইবোনের বিয়োগ বেদনা বুকে নিয়ে ঈদের জামাতে সামিল হয়েছি। কিন্তু দুঃখকষ্ট যাই হোক, এবার ত্যাগের মন্ত্রে আমরা উদ্বুদ্ধ এবং যে কোনো ত্যাগের মূল্যে স্বাধীনতার ঘোষিত লক্ষ্যে পৌছতে বদ্ধপরিকর। দেশকে শত্রুকবল মুক্ত করার পরই মাত্র ঈদুল ফতেহ্ বা বিজয়ের ঈদ উৎসব পালন করবো এবং সেদিন খুব দূরে নয়, এই প্রতিশ্রুতি আমি আপনাদের দিতে পারি।প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন নজরুল। 

তবে মুজিব নগর সরকারের মধ্যে সেসময় আভ্যন্তরীন একটা অস্থিরতা চলছিলো। এর কারণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। মার্কিন দুতাবাসের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করছিলেন তিনি। মুজিবকে মুক্তি দিয়ে দুই পাকিস্তানকে এক রাখার জন্য ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে মার্কিনিদের অনুরোধ করছিলেন মোশতাক। তার পক্ষত্যাগের একটি সম্ভাবনা নিয়েও ইঙ্গিত রয়েছে বিভিন্ন দলিলে। পরিকল্পনাটা এমন যে জাতিসংঘে মুজিব নগর সরকারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যাবেন মোশতাক। সেখানে গিয়ে ভারত ও মুজিব নগর সরকারের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য জানাবেন তিনি। অক্টোবরেই এটি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় গৃহবন্দী করা হয় মোশতাককে। এর বাইরেও যে নানা শীতল যুদ্ধ চলছিলো তার প্রমাণ মেলে কলকাতায় ঈদের জামাতে। তাজউদ্দিন ও প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এমএজি ওসমানী ছাড়া সরকারের পদস্থ কেউ উপস্থিত ছিলেন না সেখানে। এমনকি মওলানা ভাসানী সেদিন কলকাতায় থাকার পরও জামাতে যাননি। সিআইয়ের দলিলে দেখা যায় ঈদের দিন সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি দিল্লী যান মাওলানা ইন্দিরার সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য। 

উপস্থিতদের অন্যতম ওসমানীর এডিসি লে. শেখ কামাল। মুজিবের বড় ছেলেকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে যখন তাজউদ্দীন, একই সময় প্রচণ্ড জ্বরে কাতড়াচ্ছেন তার একমাত্র পুত্র সোহেল তানজিম। সিরু মিয়া তাজউদ্দীনের পুরা পরিবারকে সীমান্ত পারি দিয়ে নিয়ে আসার পর থেকে সিআইটি রোডে একটি ফ্লাটে ওঠেন তারা। প্রতিবেশীদের মধ্যে আছেন সৈয়দ নজরুল, মোশতাক ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। কিন্তু তাজউদ্দীন তার দপ্তরকেই ঘর বানিয়েছেন, গোটা যুদ্ধকালে পরিবারের ধারে কাছেও যাননি। মুজিব নগরের পাবলিক রিলেশান অফিসার নজরুল ইসলামের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে সেদিনের ঘটনা।সারাদিন কিছুই মুখে তুলেননি তাজউদ্দীন। তার দপ্তরে সেদিন কোনো বিশেষ খানাপিনার আয়োজন ছিলো না। বাইরে থেকে যা এসেছে সব বিলিয়ে দিয়েছেন অফিসের লোকজনকে। ঈদের রাতে মুক্তাঞ্চলে একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান তিনি। সেখানেই প্রথম কিছু মুখে দেন, যোদ্ধাদের রান্না করা সেমাই। ফেরার সময় সিআইটি রোডের সামনে গাড়ি ধীর গতি হয়, ভারতীয় সিকিউরিটি অফিসার বোস জিজ্ঞাস করেন, গাড়ী থামাবো স্যার। তাজউদ্দীন বলেন, না। বোস আমতা আমতা করে বলেন, স্যার, বাসার ছেলেটির গায়ে একশ ডিগ্রীর বেশী জ্বর। গত দুতিন দিন ধরে ভুগছে। তাজউদ্দীন কোনো কথা বলেননি। 

উত্তরটা নজরুল পেয়েছেন ক’দিন পর। অনেক কথার শেষ কথাগুলো ছিলো: চিন্তাটা শুধু কলকাতায় ভারত সরকারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের জন্য কেন? আমরা কি এখানে আমাদের বউ ছেলেমেয়েদের সাময়িক আশ্রয়ের জন্য এসেছি? অসুখবিসুখের কি কারো প্রতি বিশেষ দয়ামায়া আছে? অসুখ বিসুখকি শুধু নিরাপদ স্থানে আশ্রিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ছেলেমেয়েকেই দেখছে? পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে সেদিন রাতে বাংলাদেশের যে উদ্বাস্তু শিবিরগুলো দেখে এলেন, অসুখবিসুখ জ্বরজারির দৃষ্টি কি সেখানকার ছেলেমেয়ের উপর পড়েনি? দখলীকৃত বাংলার অসহায় কোটি কোটি মানুষের ঘরেও তো অসুখবিসুখ হতে পারে। মন খুলে বলুন, তাজউদ্দীনের বউ ছেলেমেয়েরা কি তাদের চেয়েও অসহায় অবস্থায় আছে? সত্যি আমি দুঃখিত। খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে আপনারা আমাকে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন। ভারত সরকারের সুরক্ষিত আশ্রয়ে কলকাতা শহরে আমাদের কে কোথায় অসুখে পড়েছে, কিংবা দু-এক বেলা খেতে পাচ্ছে না এসব চিন্তা ছাড়েন তো! যারা নিরাপদে বেঁচে আছে তাদের একজন-দু’জনের কথা ভাবলে তো চলবে না। পাকিস্তানী জল্লাদদের হাতে জিম্মি দেশের কোটি কোটি মানুষকে কেমন করে মুক্ত করবো, দেশকে কেমন করে উদ্ধার করবো, সেসব বিষয় নিয়ে ভাবুন, চিন্তা করুন। 

তাজউদ্দীন অল্প কথাতেই সব বলে দিয়েছিলেন। অনেক দূরে পাকিস্তানী কারাগারে কেমন কেটেছিলো বঙ্গবন্ধুর ঈদ? জানা যায়নি। 

ছবি : রৌমারী সীমান্তে একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছবিটির তারিখ বলছে এটি ঈদের দিন তোলা।



সূত্র : সাপ্তাহিক জয় বাংলা : মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকা 

একাত্তরের দিনগুলি : জাহানারা ইমাম 

ঘাতকের দিনলিপি : রমেন বিশ্বাস

একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা: নজরুল ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টর ও আমার যুদ্ধকথা : ওবায়দুর রহমান মোস্তফা

পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নাল, ভারতীয় ও মার্কিন নথিপত্র

 

লেখকঃ অমি রহমান পিয়াল