চৌধুরী মঈনউদ্দিন : ভয়ঙ্কর এক খুনীর কথকতা
…ঘাতক, তোমার হৃদয় জুড়ে
কালো শকুন বসত করে
ঘর বেধেছে কালো শেয়াল
সাপের মতো পেচিয়ে আছো
বাংলাদেশের সবুজ জমিন,
ফনার ভেতর লুকিয়ে আছে হিংস্র থাবা
বুকের ভেতর বিষের থলি,
চিনতে তোমায় নেই তো বাকি
মধ্যরাতে আবার তুমি নগ্ন হয়ে নামতে পারো,
স্বার্থ বুঝে থামতে পারো,
মেলতে পারো ডানা আবার
এই মাটি এই আকাশ জুড়ে…
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটা পরবর্তী বিজয় দিবসগুলোর মতো ঠিক উদযাপনের অবস্থায় ছিলো না। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ মানে ছিলো আসলে স্বস্তি, নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ তাহলে থামলো। একইসঙ্গে বাঙালী জল ভেজা চোখে বেরিয়েছে নিখোজ স্বজনদের খোঁজে, লাশ হলে লাশ, হাড় হলে হাড়। মনে পড়ছে একটি খুলির সামনে নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকা তিন বোনের সেই ছবিটি। খুলিটা তাদের বাবার। সারা বাংলাদেশ তখন মাইলাই-ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য গণকবর। স্বাধীনতার দু’দিন পর রায়েরবাজারে আবিস্কৃত হলো একটি বধ্যভূমি, বাঙালীর মধ্যে বিজয়ের আনন্দের যেটুকু ছিটেফোটা ছিলো তাও কেড়ে নিলো জঘন্য হত্যাকাণ্ডের এই নির্মম সাক্ষ্য। পরিত্যক্ত এক ইটভাটার জলমগ্নতায় চোখ বাধা, হাত বাধা অবস্থায় পড়ে ছিলো অসংখ্য লাশ। এই লাশগুলো বুদ্ধিজীবিদের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যখন স্রেফ সময় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন মরণ কামড় হিসেবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কাজে লাগায় তাদের পোষ্য দালালদের। স্বাধীন একটি দেশ যাতে মেধাশূন্যতায় ভোগে, মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেজন্য হত্যা করার নির্দেশ দেয় তারা এসব মেধাবী বাঙালীকে। সে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে জামাতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের (এখন ইসলামী ছাত্র শিবির) সদস্যদের নিয়ে গঠিত খুনে বাহিনী আল-বদর। ব্ল্যাক আউট আর কারফিউর ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাটি লেপা গাড়ি নিয়ে তারা হানা দেয় খতম তালিকায় থাকা বুদ্ধিজীবিদের বাসভবনে। সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক- কে ছিলো না তাদের সেই তালিকায়!
পচাগলা সেসব লাশের তীব্র দুর্গন্ধ উপেক্ষা করে স্বজনেরা যখন তাদের চেনার চেষ্টা করছেন, তখন ক্রোধে উন্মক্ত একদল মুক্তিযোদ্ধা নেমে পড়েছেন নৃশংস এসব খুনীর খোঁজে। পেয়েও গেলেন একজনকে- আবদুল খালেক মজুমদার। জামাতী ইসলামীর তখনকার দফতর সম্পাদক এই দালাল ও ঘাতক শহীদুল্লাহ কায়সারকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জেরায় খালেক জানায় এসব বুদ্বিজীবি হত্যার নাটের গুরুর কথা। চৌধুরী মঈনউদ্দিন। সেসময় দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় সাংবাদিক সেজে থাকা এই কুখ্যাত খুনীই ছিলো আল-বদরদের কিলিং মিশনের অপারেশন ইনচার্জ। সঙ্গত কারণেই মোস্ট ওয়ান্টেড এই ক্রিমিনাল ততদিনে দেশছাড়া। খালেক তার জবানবন্দীতে জানায় ১৪ ডিসেম্বর মঈনউদ্দিনের সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়। এদিন জামাতে ইসলামীর ঢাকা শহর প্রধান সারওয়ার ও মঈনউদ্দিন জামাত অফিসে এসে সব টাকাপয়সা নিয়ে যায়। এরপরই পালায় সে।
সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত ও নেপাল হয়ে মঈনউদ্দিন পৌছায় পাকিস্তানে। সেখানে হাজিরা দেয় গোলাম আযমের কাছে। পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে যায় সৌদি আরব। বাংলাদেশ নাস্তিক হয়ে গেছে (ধর্ম নিরপেক্ষতার জামাতি ব্যাখ্যা), সেখানে সব মসজিদ এখন মন্দির- ইত্যকার মিথ্যাচারে যোগাড় করে বাদশাহী ফান্ড। এই ফান্ড জোগাড়ে গোলাম আযম ছাড়াও তার সঙ্গী ছিলো সিলেটের কুখ্যাত আল-বদর ঘাতক আবদুর রাজ্জাক এবং পাকিস্তান জামাতে ইসলামী নেতা মিয়া মোহাম্মদ তোফায়েল। এই ফান্ডের উদ্দেশ্য ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘাটি বানিয়ে সারাদেশে অরাজকতা সৃষ্টি ও জাতীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা। জামাত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ এ সময় ছাতা মেরামতকারীর ছদ্মবেশে গোটা দেশে ছাত্র সংঘ ও জামাত নেতাদের গোপনে সংগঠিত করতে থাকেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর অবশ্য জামাতের সেই অপারেশন চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আর পড়েনি। পাশাপাশি ব্রিটেনে দাওয়াতুল ইসলাম নামে জামাতের একটি ফ্রন্টের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় মঈনউদ্দিনকে। সেখানে ইস্ট লন্ডন মসজিদকে ঘাটি বানিয়ে সে সাপ্তাহিক দাওয়াত নামে একটি জামাতি প্রকাশনার সম্পাদনা চালিয়ে যায়।
‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখক সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমেই লাইমলাইটে চলে আসে মঈনউদ্দিন। ব্রিটেনের বিশিষ্ট নেতাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় সে। ১৯৯৫ সালে লন্ডনের টুয়েন্টি টুয়েন্টি টেলিভিশন ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে যাতে মঈনউদ্দিন ছাড়াও আবু সাঈদ ও লুতফর রহমান নামে ব্রিটেন আত্মগোপন করা তিন ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধীর সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা ছিলো। চ্যানেল ফোর থেকে পরিবেশিত এই ডকুমেন্টারিতে মঈনউদ্দিন এক লিখিত বক্তব্যে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি জানায়। সে সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে অভিহিত করে। কিন্তু এসবই এই ঘৃণ্য খুনে বদমাশটার নির্লজ্জ মিথ্যাচার।
১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসে ফক্স বাটারফিল্ডের লেখা ‘আ জার্নালিস্ট ইজ লিংকড টু দ্য মার্ডার অব বেঙ্গলিজ’ নামে একটি বিশেষ রিপোর্ট ছাপা হয়। এতে বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডে মঈনউদ্দিনের সংশ্লিষ্ঠতার আদ্যোপান্ত বর্ণনা ছিলো। সেখানে পূর্বদেশ সম্পাদক এহতেশাম চৌধুরীর বয়ানে মঈনউদ্দিনের বিরুদ্ধে তার ভাইকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এহতেশাম নিজে রক্ষা পান অফিসে আশ্রয় নিয়ে। ফক্সের প্রতিবেদনে লেখা হয় :
To his fellow reporters on the Bengali-language paper where he worked, Chowdhury Mueenuddin was a pleasant, well-mannered and intelligent young man…there was nothing exceptional about him except perhaps that he often received telephone calls from the leader of a right-wing Moslem political party. But, investigations in the last few days show that those calls were significant. For Mr. Mueenuddin has been identified as the head of a secret, commando like organization of fantatic Moslems that murdered several hundred prominent Bengali professors, doctors, lawyer and journalists in a Dhaka brick yard. Dressed in black sweaters and khaki pants, members of the group, known as Al-Badar, rounded up their victims on the last three nights of the war…Their goal, captured members have since said, was to wipe out all Bengali intellectuals who advocated independence from Pakistan and the creation a of a secular, non Moslem state.
…According to one captured member now being held in the Dacca jail, the reporter, Mr. [Choudhury] Mueenuddin, had been the master-mind of the organisation. A diary belonging to Mr. Mueenuddin’s room-mate has been found. It listed the names of Al Badar members and how much money they contributed to the group. The two men lived next door to the Dacca headquarters of Jamaat-e-Islami, a right-wing Moslem political party that ran in the last elections for the National Assembly last year but won less than one per cent of the vote. Al Badar is believed to have been the action section of Jamaat-e-Islami, carefully
organised after the Pakistani crackdown last March.
Mr. Mueenuddin was last seen on 13 December after having an argument with a fellow reporter at their paper, Purbodesh. That reporter was kidnapped from his house by Al Badar a few hours later.
এর আগে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১, ডেইলি অবজারভারে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয় : “Chowdhury Mainuddin, a member of the banned fanatic Jamaat-e-Islami, has been described as the “operation-in-charge” of the killing of intellectuals in Dhaka by Abdul Khaleq, a captured ring leader of the Al-Badr and office bearer of the Jamaat-e-Islami.”
নিউইয়র্ক টাইমসে তার যেই সঙ্গীর কথা বলা হয়েছে তার নাম আশরাফুজ্জামান , ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। মঈনউদ্দিন ছিল অপারেশন ইন চার্জ আর আশরাফুজ্জামান ছিলো প্রধান জল্লাদ বা চিফ একজিকিউশনার। যে গাড়ি করে ঘাতকেরা বুদ্ধিজীবিদের রায়ের বাজারের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে নিয়ে যেত, তার ড্রাইভার মফিজুদ্দিন ধরা পড়ার পর জবাববন্দীতে তার এই পরিচয়ই দেয়। দুজনে জামাতে ইসলামী অফিসের উল্টোদিকে থাকত। আশরাফুজ্জামানের ৩৫০ নম্বর নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী। সেখানে দুটো পৃষ্টায় ২০জন বুদ্ধিজীবির নাম পাওয়া যায় যাদের মধ্যে ৮ জনকে হত্যা করা হয়। তারা হলেন মুনীর চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের , গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, রশিদুল হাসান, ড. ফয়জুল মহী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডাক্তার গোলাম মুর্তজা। এদের প্রত্যেককে আশরাফুজ্জামান নিজে গুলি করে হত্যা করেছিল বলে জবানবন্দী দেয় মফিজুদ্দিন। ডায়েরির অন্যান্য পাতায় দালাল বুদ্বিজীবিদের নামের পাশাপাশি আল-বদরের হাই কমান্ডের নামের তালিকা ছিলো। এতে মঈনউদ্দিন ছাড়াও ছিল কেন্দ্রীয় কমান্ড সদস্য শওকত ইমরান ও ঢাকা শহরপ্রধান শামসুল হকের নাম।
আশরাফুজ্জামান যেসব সাংবাদিককে হত্যা করেছিল তার মধ্যে অন্যতম পূর্বদেশের শিফট ইনচার্জ ও সাহিত্য পাতা সম্পাদক আ.ন.ম গোলাম মোস্তফা। ঘটনার কয়দিন আগে মঈনউদ্দিনের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। গোলাম মোস্তফা জামাতে ইসলামীর সমালোচনা করায় মঈনউদ্দিন তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। ওয়ার ক্রাইমস ফাইলে এক সাক্ষাতকারে এই ঘটনাটা বলেছেন আতিকুল ইসলাম যিনি টাইমসের প্রতিবেদনে পন করেছিলেন মঈনউদ্দিনকে যেভাবেই হোক খুজে বের করার। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খালেকের নিশ্চিত মৃত্যু ঠেকিয়ে তাকে দিয়ে জবানবন্দী নেওয়ার সুপারিশটা আতিকের। মঈনউদ্দিনকে নিয়ে পত্রিকায় প্রথম প্রতিবেদনটিও তার। আর এই প্রতিবেদনের ছবি দেখেই মঈনউদ্দিনকে বুদ্ধিজীবি অপহরণে সনাক্ত করেন অনেকেই। এদের মধ্যে ছিলেন প্রানে বেঁচে যাওয়া বিবিসির বাংলাদেশ সংবাদদাতা আতাউস সামাদের দুই প্রতিবেশী, নিহত সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন স্ত্রী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী ডলি চৌধুরী। এই মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছাত্র ছিলো মঈনউদ্দিন এবং একপর্যায়ে তার মুখ ঢেকে রাখা রুমালটা সরে গেলে তাকে চিনে ফেলেন তারা। আশরাফুজ্জামানের ডায়েরিতে আতিকুল ইসলামের নামও ছিল। কিন্তু সেটি ছিল ভূল ঠিকানা। মঈনউদ্দিনকে সন্দেহ করতেন বলেই আসল ঠিকানাটা দেননি তিনি।
স্বাধীনতার পর স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো আল-বদরদের গ্রেপ্তারে। তালিকায় শীর্ষ নামটি ছিলো চৌধুরী মঈনউদ্দিনের। ফেনীর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সাংসদ জয়নাল আবেদীন নির্দিষ্ট দায়িত্ব পেয়েছিলেন মঈনউদ্দিনকে গ্রেপ্তারের। কিন্তু অনেক খুঁজেও তার হদিস পাননি। ঘাতকদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছিল। এদের মধ্যে ’৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জেল ভেঙ্গে পালানোর সময় নিহত হয় অনেকে। শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণের অভিযোগে খালেকের মাত্র সাত বছর কারাদন্ড দেয় আদালত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এসব অভিযোগের আর কোনো মূল্য থাকেনি। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ মুক্তি পাওয়ার পর আবারও কিছু মামলা হয়। ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে হত্যার অভিযোগে মঈনউদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামী করে তার বোন ফরিদা বানু রমনা থানায় একটি মামলা করেছিলেন। ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর দায়ের করা এই মামলায় (ওই তারিখের কেস নম্বর- ১১৫) প্রচলিত দন্ডবিধির ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র (১২০খ), অনধিকার গৃহপ্রবেশ (৪৪৮), খুন করা উদ্দেশ্যে হরন বা অপহরন (৩৬৪), খুন (৩০২), অপরাধীকে গোপন করার জন্য অপরাধের সাক্ষ্য অদৃশ্য করে দেওয়া বা মিথ্যা তথ্য সরবরাহ (২০১), অপরাধ অনুষ্ঠানে সহায়তা (১১৪) প্রভৃতি অভিযোগ আনা হয়। সিআইডির তখনকার সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান মামলাটির কেস অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং নিহত বুদ্ধিজীবিদের ৪০ জন আত্মীয়স্বজনের সাক্ষ্য নেন।
ফাইনাল রিপোর্টে সিআইডি মামলাটি প্রচলিত আদালতে না করে স্পেশাল ট্রাইবুনাল এক্টে দায়ের করার সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে পাঠায়। এরপর মামলাটির আর খবর পাওয়া যায়নি। ফরিদা বানু মন্ত্রনালয়ে অনেকবার খোঁজ নিয়েছেন, কিন্তু তখন ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামাত জোট তাকে নিরুৎসাহিত করে। তবে সাক্ষীদের অনেকেই এখনও বেচে আছে। অনেকে সাক্ষী হতে চান। এদের একজন ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মেজবাহউর রহমান চৌধুরী। একাত্তরে তিনি মৌলভীবাজারে ইসলামী ছাত্র সংঘ করতেন। এক সংবাদ সম্মেলন তিনি ছাত্রসংঘের সদস্যদের বাধ্যতামূলক আল-বদরে যোগ দেওয়ার চিঠি তুলে জানিয়েছেন প্রাসঙ্গিক নানা কথা। নিজামী-মুজাহিদ-কামারুজ্জামান-চৌধুরী মাঈনউদ্দিনসহ ১৫ জন ঘাতক ও দালালের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যথেষ্ট প্রমান তার হাতে রয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ তথ্যচিত্রটিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ওয়ার ক্রাইমস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান লর্ড আর্চার অব স্যান্ডওয়েল জানিয়েছিলেন ব্রিটেনেই মঈনউদ্দিনসহ অন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব। ব্রিটিশ আইনে ১৯৫৭ সালের জেনেভা কনভেনশন অ্যাক্ট অনুযায়ী সেদেশে লুকিয়ে থাকা যে কোনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অধিকার ব্রিটিশ সরকারের আছে। চ্যানেল ফোর এবং যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালীরা তখন একটি আন্দোলন করেছিলেন যার সুবাদে ব্রিটিশ সরকার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে এসব যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয়। ’৯৬ সালের প্রথম দিকেই তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে কথিত আওয়ামী লীগ সরকারের এ ব্যাপারে নিরুৎসাহ দেখা যায়। অভিযোগটা এসেছিল লন্ডনের বিশিষ্ট আইনজীবি ও মানবাধিকার নেত্রী ফিওনা ম্যাকির তরফে।
ক্ষমতার পালাবদলে আবারও শাসনভার আওয়ামী লীগের হাতে। এবারে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে তারা রেখেছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকেই। সে বিচার শুরু হয়েছে। কিন্তু ঘাতকশীর্ষ এই মঈনউদ্দিনকে বাদ দিয়ে কিভাবে পূর্ণতা পাবে এই বিচার! তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই ব্রিটেনেই ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের সাফল্যের ভিতটা রচিত হয়েছিল। করেছিলেন দেশপ্রেমিক বাঙালীরা। এই ব্রিটেনেই মুক্তিযুদ্ধের শেষ লড়াইটা লড়তে পারেন তাদের উত্তরসূরীরা। আইন আছে আপনাদের পক্ষে। বাংলাদেশ সরকারও এবার কোনো অজুহাত দেখাতে পারবে না যদি আপনারা আন্তরিকভাবে এই যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলার দাবিতে মাঠে নামেন, তাকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেন ব্রিটিশ সরকারকে। ৩০ লাখ শহীদের আত্মা আপনাদের জন্য প্রার্থনা করবে, আপনাদের সঙ্গে থাকবে। জাগো ভায়েরা, চলো যুদ্ধটা শেষ করি।
তথ্যসূত্র :
১.ওয়ার ক্রাইমস ফাইল : তথ্যচিত্রটির ফুটেজ ব্যবহার করে ভিডিও দুটো তৈরি করা হয়েছে
২. নিউ ইয়র্ক টাইমস
৩. একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায়
৪. একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
৫. মেজবাহউর রহমান চৌধুরীর সাক্ষাতকার
৬. ডেইলি স্টার
(গুরুত্বপূর্ণ দলিল এই পোস্টটি নতুন ভার্সানে পাওয়া যায়নি, তাই আবার পোস্ট করা হলো)