মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি -ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম
গত দু’দশকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যতটা লেখা উচিৎ ছিল, ইতিহাসবিদ,গবেষক বা অংশগ্রহণকারীরা ততটা লেখেননি ঠিকই,তবে প্রতিবছর কিছু না কিছু লেখা হচ্ছে।প্রকাশিত হচ্ছে নতুন তথ্য,জড়ো হচ্ছে ইতিহাসের উপাদান।মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস রচনার জন্য,ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য।
আজকের তরুন জন্ম থেকেই স্বাধীন দেশের নাগরিক কিন্তু এর জন্য পূর্ববর্তী প্রজন্মকে যে কি মূল্য দিতে হয়েছে সে সম্পর্কে হয়ত তার ধারনা তেমন স্পষ্ট নয়।যদি সে ধারনা স্পষ্ট হয় তা হলে দেশ,স্বাধীনতা সম্পর্কে তার মমত্ববোধ অন্য মাত্রা পেত।এর জন্য অবশ্য কম বেশি দায়ি আমরা সবাই।গত দু’দশকে রাষ্ট্রীয় পোষকতায় এবং নিজ় চেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে অজস্র বই প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল তা হয় নি।বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলার চেষ্টাই লক্ষণীয়।
মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে সব বই প্রকাশিত হয়েছে গত দু’দশকে তার অধিকাংশই প্রত্যক্ষদর্শীদের লেখা।অর্থাৎ যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন যুদ্ধে বা প্রবাসী সরকারের সঙ্গে বা তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা যারা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি বেঁচেছিলেন।এখানে উল্লেখ্য,বাংলাদেশে যারা পেশাগতভাবে ইতিহাস রচনার সঙ্গে যুক্ত মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে লেখা তাদের খুবই সামান্য।আমাদের জন্য, প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণী উপাদান হিসেবে মূল্যবান।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে।আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য সক্রিয় ছিল বিভিন্ন সংগঠন।তবে প্রবাসী সরকার, তার নেতৃত্ববৃন্দ, স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনায় বিভিন্ন সংগঠনের সাহায্য সহায়তা বা বিরোধিতা সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্টভাবে জানা প্রয়োজন।তবে, সমস্যা হচ্ছে এ ধারার বইয়ের সংখ্যা কম হতে পারে,প্রবাসে এমন সব ঘটনা ঘটেছিল যার বিবরন কেউ দিতে চান না।
এ ধারার বইয়ের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল-ইসলামকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ক’জন নেতা প্রথম প্রবাসী সরকার সংগঠন করেছিলেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও তার সঙ্গেই সরকারি পর্যায়ে প্রথম দিল্লীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিলো।স্বাধীনতার পরও সরকারে ছিলেন তিনি এবং এখন পর্যন্তযুক্ত আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে।
গত এক দশক ধরে এরশাদের বিরুদ্ধে আইনজীবিদের সোচ্চার প্রতিবাদ উৎসাহ ও সাহস জুগিয়েছিলো দেশবাসীকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।আইনজীবীদের সংগঠন ও অন্যান্য অরাজনৈতিক সংগঠনে থেকে স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে যে ক’জন গত বছর গুলোতে রাস্তায় ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম অন্যতম।গত বছর সরকার উৎসাহিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনেও তিনি ছিলেন তৎপর।
আমীর উল ইসলামের স্মৃতিচরন পর্বের শুরু ১৯৭১ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা আগমন থেকে তার স্মৃতিচারন থেকে জানা যায়,ভুট্টো আসলেই সমঝোতা চাননি, নির্ভর করেছিলেন তিনি ক্যান্টনমেন্টের ওপর যেমন এখনও করে থাকেন অনেক রাজনীতিবিদ। পচিশ মার্চ এ ধরনের ঘটতে পারে এ সম্পর্কেও জানতেন আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ।শেষ মুহুর্তেও তাজউদ্দিন আহমেদ, আমীর-উল ইসলাম প্রমূখ চাপ দিয়েছিলেন প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর যাতে তিনি আত্মগোপন করেন কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি।
তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে একত্রে আমীর-উল ইসলাম চলে যান সীমান্তের ওপারে এবং তাদের সঙ্গে প্রথম দিল্লীর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এ পর্যায়ে তিনি প্রবাসী সরকার গঠনে প্রতিবন্ধকতা, দ্বন্দ্ব , রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মনোমালিন্যের কথা অকপটে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসংগে বেশ কিছু নতুন তথ্য জানা যায়।মুজিব বাহিনী কি ভাবে গঠিত হলো সে ইতিহাসও বিধৃত হয়েছে।স্মৃতি কাহিনীর প্রতিটি পাতায় ফুটে উঠেছে কিভাবে তাজউদ্দিন আহমেদ ধৈর্য্য,প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের কারনে প্রবাসী সরকার সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠেছিল।এ স্মৃতি কাহিনী পড়ে মনে হয়, তাজউদ্দীন আহমদ না থাকলে হয়ত আমাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়তো।তৎকালীন মেজর ও পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কেও বেশ কিছু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য আছে এ গ্রন্থে।
প্রবাসী সরকার সম্পর্কে এ পর্যন্ত লেখা হয়েছে সবচেয়ে কম।কারন, সবাই হয়ত ঐ সময় টা ভুলে থাকতে চান। ব্যারিস্টার এম.আমীর-উল ইসলাম ঐ সময়টি স্মরণ করে স্মৃতিচারণ করেছেন সেজন্য তিনি আমাদেও ধন্যবাদার্হ।এ কারনে হয়ত তিনি অনেকের বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হবেন, কিন্তু আমাদের বলতে দ্বিধা নেই,মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার সময় তার স্মৃতিকাহিনী মূল্যবান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
মুনতাসীর মামুন
ইতিহাস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পৌষ, ১৩৯৭