শহীদ আশুরঞ্জন দে : আমার বাবার স্মৃতিতে

[ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা ডা. শফিকুর রহমানের পোস্টিং ছিলো ব্রাক্ষণবাড়িয়া। সদর হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন তিনি সেসময়। আহত মুক্তিযোদ্ধা আশুরঞ্জনের এই অংশটুকু আমি প্রথম পাই তার ডায়েরিতে। প্রথম আলোতে কর্মরত থাকা অবস্থায় এই অমূল্য ডায়েরিটি আমি হারিয়ে ফেলেছি। তবে এটি বাবা তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পান্ডুলিপি ‘যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ’-এ যোগ করেছিলেন। সেখান থেকেই তুলে দিলাম। আশু হত্যাকাণ্ডের ঠিক একমাস পর একই নিয়তি বরাদ্দ হয়েছিলো আমার বাবার জন্যও। পবিত্র শবেবরাতে ইফতারির দাওয়াত দিয়ে শহরের সব বুদ্ধিজীবিদের সেদিন আটক করা হয় এবং কুরুলিয়া খালের পাশে দাড় করিয়ে হত্যা করা হয়। স্রেফ দৈবে রক্ষা পান বাবা, কোনো কারণে তার যেতে দেরি হয়েছিলো সেখানে। কুখ্যাত আল-বদর আমিনুল হকের (আমি আলবদর বলছি বইয়ের লেখক) হিটলিস্টেও নাম ছিলো বাবার। সরাইলে সপরিবারে আশ্রয় নিয়ে সেবার রক্ষা পাই আমরা। আরেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নুরুকে নিয়েও একটি স্মৃতিকথা আছে বাবার, খুজে পাচ্ছি না। ডায়েরির সঙ্গেই হারিয়ে গেছে হয়তো ]
…ওই সময় ব্রাক্ষণবাড়ীয়ার এসডিও ছিলেন জনাব মোফাজ্জল করিম। শহরের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের থেকে শুরু করে পুলিশ, আনসার, ইপিআর সবাই প্রত্যক্ষভাবেই স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করছেন। ওদিকে হানাদারদের স্যাবর জেট প্রায়ই মেশিনগান স্ট্র্যাপিং করে যাচ্ছে, ফলে ভীত শহরবাসী পালাচ্ছে এদিকে ওদিকে।
ডাঃ ফরিদুল হুদা, ডাঃ রশিদ, ডাঃ আবদুল্লাহ, ডাঃ রফিকুল ইসলাম, ডাঃ মতিন প্রমুখ একে একে শহর ছাড়লেন। সদর হাসপাতালের এসডিএমও ডাঃ খায়রুল বাশারের তখন জলবসন্ত দেখা দিয়েছে। উনিও চলে যেতে বাধ্য হলেন। ওনার সহকারি ডাক্তারও ছুটিতে বাড়ী গিয়ে আর ফিরে আসেননি। সদর হাসপাতালে বেশ কিছু আহত রুগি আছে যাদের দৈনন্দিন চিকিৎসা সেবা প্রয়োজন। এদের কথা ভেবেই আমি রয়ে গেলাম এবং সদর হাসপাতালের রুগিদের দেখাশোনা শুরু করলাম।
তখন শহরে আমিই একমাত্র সরকারী চিকিৎসক, আর বেসরকারীদের মধ্যে রয়ে গেলেন আজীবন মুসলিম লিগার ডাঃ ধন মিয়া। আমার স্ত্রী তখন অন্তঃস্বত্ত্বা। তাকে সরাইল পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চাঁদপুরের ডাঃ আবুল খায়ের গোলজারের বাসায় রেখে এলাম। আমি সকাল ৮টায় ব্রাক্ষণবাড়ীয়া শহরে আসতাম, আর ফিরতাম রাত ৮ টায়। পরিস্থিতির কারণেই যক্ষা হাসপাতালের পাশাপাশি সদর হাসপাতালের দায়িত্বও আমাকেই দেখতে হতো।
একদিন হানাদার সৈন্যরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে কুরুলিয়া সেতু অতিক্রম করছিল। আমাদের সদাজাগ্রত বেঙল রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের সন্দেহ হওয়ায় তিনি গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এতে একজন তরুণ পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন সহ বেশ কজন হানাদার নিহত হয়।
কিন্তু পাকসেনারা ক্ষান্ত দেয় না। তাদের হামলা অব্যহত থাকে। এইরকম চাপের মুখে বেঙল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার, মহকুমা প্রশাসক ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রাক্ষনবাড়ীয়া সাময়িকভাবে ত্যাগ করার। পাকিদের বিমান হামলা ততদিনে আরো জোরদার হয়েছে। মেজর খালেদ মোশাররফ সহ মুক্তিবাহিনী কৌশলগত কারণেই তাই ব্রাক্ষণবাড়ীয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হন- কারণ প্রতিপক্ষ কুমিল্লা থেকে আগত বিপুল পরিমাণ শত্রুসেনা ও তাদের গোলন্দাজ আক্রমণ।
এরপর সহজেই পাকসেনারা ব্রাক্ষণবাড়ীয়া ঢুকে পড়ে। রাজাকার বাহিনীতেও লোকনিয়োগ শুরু হয়ে যায়। ব্রাক্ষনবাড়ীয়ার প্রথম রাজাকার ডাঃ ধন মিয়ার বড় ছেলে। সরকারী নির্দেশে প্রতিটি মহল্লা ও গ্রাম থেকে রাজাকার নিয়োগ চলছিল। কোনো গ্রাম থেকে রাজাকার না এলে সেই গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই নির্দেশ দেওয়া হয় ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রেও, অর্থাৎ কেউ রাজাকারে ভর্তি হতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে বসতবাটিসহ উচ্ছেদ তো বটেই আত্মীয়স্বজনসহ জানে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়।…
…সেসময় কসবা সেক্টরে ভারতের দিক থেকে অবিরাম শেলিং হচ্ছিল মুকুন্দপুর, সিংগার বিল প্রভৃতি গ্রামগুলোতে। মেজর আবদুল্লাহর নির্দেশে আমাকে সেখানে যেতে হয়। মুকুন্দপুর গিয়ে ৮টি পাক বাংকারে শেলিংয়ের ধ্বংসলীলা আমি দেখতে পাই। পাক আর্মির ৪০ জনেরও বেশি মৃত ও প্রায় দেড়শ আহত- যাদের অবস্থা মারাত্মক তাদের কুমিল্লা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। অন্যদের দুটি বাস বোঝাই করে ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে এলাম। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। হঠাৎ নির্দেশ এল ওই স্থান ত্যাগ করার। কারণ নতুনভাবে শেলিং শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমরা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে তিনশ গজও পেরোইনি- শুরু হলো কানফাটা শেলিং। ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়ে বিপদসীমা পার করে।
এদিকে মুক্তিসংগ্রাম পুরোদমেই চলছে। সেইসঙ্গে রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের দৌরাত্ম। তখনও পর্যন্ত কোনো আহত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখার দূর্ভাগ্য আমার হয়নি। প্রথম যাকে দেখলাম, তিনি ভৈরবের বীর সন্তান আশুরঞ্জন দে। আগরতলায় ট্রেনিং শেষ করে ওনারা প্রায় আড়াইশ মুক্তিযোদ্ধা ২১ অক্টোবর ’৭১ সীমান্ত অতিক্রম করেন। দিনের বেলা ওনারা লুকিয়ে থাকতেন আর পথ চলতেন রাতের অন্ধকারে। নৌকায় করে পাকদালাল ও রাজাকারদের চোখ ফাকি দিয়ে রাসুটিয়া ইসলামপুর হয়ে তারা মজলিশপুর পৌছেন। এই পথের প্রায় গ্রামগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, তাদের এসকর্ট ও ইনফর্মার ছিল তাই অনেক। এদেরই সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ২৫ অক্টোবর মজলিশপুর পৌঁছে।
এ দলের নেতা ছিলেন ভৈরবের সাহাদত হোসেন বেনু। বেনু ছাড়াও আশুর সঙ্গী ছিলেন ভৈরবের জাহের, আক্কাস, আজাদ ও আরো কয়েকজন। শেষরাতে আশুরা মজলিশপুর থেকে নন্দনপুরের রাস্তায় ডাবল মার্চ করে ছুটে চলেন। মাথায় অস্ত্রের বোঝা, লক্ষ্য সিএন্ডবি সড়ক পার হওয়া। বিরাট দলটি যখন নন্দনপুর পার হয়েছে এবং একাংশ সিএন্ডবি সড়ক পেরিয়েছেন ওমনি গুলির শব্দ হলো। এখানে অ্যামবুশ পেতেছিল রাজাকার ও হানাদারদের বিরাট একটা দল।
এই অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিবাহিনী দিশেহারা হয়ে অস্ত্রের বোঝা ফেলে আত্মরক্ষা করতে পালিয়ে যায়। আশুর উরুতে গুলি লাগে। দৌঁড়াতে অক্ষম হয়ে ধানক্ষেতে পড়ে যান তিনি। পরে হানাদাররা তাকে ও তার চার বন্ধুকে ধরে নিয়ে আসে। আশুকে রাখা হয়েছিল ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহরের কালিবাড়িতে যার নতুন নাম করণ করা হয়েছিল রাজাকার মঞ্জিল। বাকি ৪ জনকে জেলে পোরা হয়।
আশু ছিলেন ভৈরব কলেজের বিএ ক্লাশের ছাত্র। ভালো খেলোয়াড়। ভৈরব বাজারে ওদের মিষ্টির দোকান আছে। বাকি ৪ জনের একজন ব্রাক্ষনবাড়িয়া কলেজের ছাত্র।
আশুকে দেখার জন্য মেজর আবদুল্লাহ আমাকে নির্দেশ দেয়। মনে করলাম সোনায় সোহাগা। কারণ এর আগে কোনো আহত মুক্তিযোদ্ধা দেখিনি, এবার শুধু দেখা নয় তার চিকিৎসা করারও সুযোগ পাব। আমি আশুর প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হলাম এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের সুপারিশ করলাম। কিন্তু তা অগ্রাহ্য হলো। মেজর আবদুল্লাহ শ্লেষভরা কণ্ঠে বললেন, ‘ডাক্তার তোমাকে দেখতে বলেছি, চিকিৎসা করতে নয়।’ আশুর উরু থেকে তখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। পা ফুলে ঢোল। কিন্তু আমাকে কিছুই করতে দেওয়া হলো না। এমনকি সে পিপাসার্ত হয়ে পানি চাইলে তাও দেওয়া হল না। উল্টো রাজাকাররা মাটির পাত্রে পেশাব করে তাকে খেতে দিল। আমার আজো কানে ভাসে আশুর প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠস্বর, ‘তোদের এর প্রতিদান দিতেই হবে। বাংলা মায়ের সন্তান আমি একা নই।’
২৮ অক্টোবর রাতে মৃতপ্রায় পঙ্গু আশুকে ট্রাকে করে রাজাকার মঞ্জিল থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কুরুলিয়া খালে- নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় একজন দামাল যোদ্ধাকে। পরে জানা যায় এতদিন ধরে যে রাজাকারটি মজলিসপুর-নন্দনপুর রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপার করত, সেই বিশ্বাসঘাতকতা করে আশুদের ধরিয়ে দেয়। এভাবেই মুক্তিকামী এক বীর সন্তানের রক্তে রঞ্জিত হলো ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মাটি। এদেরই পবিত্র রক্তে আজ মুক্ত এদেশ।